সিআরবি থেকে প্রস্তাবিত হাসপাতাল ও কলেজ নির্মাণ প্রকল্প অন্যত্র স্থানান্তরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ।
আজ মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) সকাল ১১ টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ আবেদন জানানো হয়।
নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সদস্য সচিব এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল।
এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের কো চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও রাজনীতিবিদ মফিজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুচ, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, প্রফেসর মো. হোসাইন কবির, পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. ইদ্রিস আলী, এডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, যুগ্ম সদস্য সচিব কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল, নাট্য ব্যক্তিত্ব সাইফুল ইসলাম বাবু, আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, বিএফইউজে যুগ্ম মগাসচিব মহসীন কাজী, পরিবেশবিদ শরীফ চৌহান প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সিআরবি চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মিত হলে পরিবেশ দূষণ ঘটবে এবং পুরো সিআরবি এলাকাটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক বলয় হুমকির মুখে পড়বে।
এছাড়া, সিআরবি এলাকায় যেহেতু বর্ষবরণসহ বছরব্যাপী নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়, এটির সংলগ্ন এলাকায় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মিত হলে তা হাসপাতালের রোগী ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদানেও তীব্র ব্যাঘাত ঘটানোর আশঙ্কা থাকবে। এক কথায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সিআরবির অনুপম ও প্রশান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়নের (ইকো) উদ্যাগে পরিচালিত গবেষণায় সিআরবিতে ১৯৭টি উদ্ভিদ প্রজাতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বড় গাছ ৭৪ প্রজাতির ও মাঝারি গাছ ৩৭ প্রজাতির, গুল্ম প্রজাতি ৬৭টি এবং লতা জাতীয় উদ্ভিদ ১৪ প্রজাতির। বিপন্ন প্রায় ৯টি প্রজাতির গাছও আছে এখানে।
সিআরবিতে ঔষধি গাছ মস, টোনা, অর্জুন, লজ্জাবতী, আপাং, নিশিন্দা, টগর, সজিনা, দেবকাঞ্চন ও মাটিসুন্দার, বিলুপ্ত প্রায় দুধকুরুস, বাঁকা গুলঞ্চ, সোনাতলা, গুলঞ্চ, সর্পগন্ধা, বকুল, পিতরাজ, দুরন্ত-এর দেখা মিলেছে। সিআরবির বৃক্ষরাজি সংরক্ষণ করা না হলে ভবিষ্যতে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
শতবর্ষী রেইনট্রিগুলোতে অনেক ধরনের পরগাছা, যেমন: ছত্রাক, শৈবাল, অর্কিড ও পরজীবীর বসবাস। এসব প্রজাতির সংখ্যা দেড়শতাধিক হবে। এছাড়া সিআরবি ব্যাঙ, সাপ ও পাখির বিচরণ ক্ষেত্র। এখানে হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প হবে তাই দেশের সংবিধান ও পরিবেশ আইন বিরোধী একটি হঠকারী ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
মানুষের চেতনা, নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষা করে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। সিআরবি আমাদের শৈশবের স্মৃতি ধন্য স্থান। সিআরবি রক্ষা করতে হবে চট্টগ্রামের স্বার্থে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য সিআরবি। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে বহু মানুষ শহীদ হয়ছেন এখানে। শহীদের সমাধির উপর রক্তাক্ত স্বাধীনতার ইতিহাস ম্লান করতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এখানে সাংস্কৃিতক বলয় গড়ে উঠেছে। আমরা মনে করি সুকৌশলে চট্টগ্রামের হৃৎপিন্ড ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
রেলওয়ে বলছে, এখানে হাসপাতাল হলে গাছ কাটা পড়বে না। অথচ হাসপাতাল নির্মাণের নির্দ্ধারিত স্থানেই তিনশ গাছ আছে শতবর্ষী গাছসহ। প্রস্তাবিত স্থানটিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুর রব, শহীদ শেখ নজির আহাম্মদ, শহীদ এম এ মনোয়ার হোসেন, বিমল সিং, ফখরুল আলম, মো. সিরাজউদ্দিন, আলী নূর চৌধুরী, মহিউদ্দিন, নুরন্নবী চৌধুরী ও গঙ্গারামের স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদ আবদুর রবের বাবার বাসা এখানে। সে বাসা থেকে তিনি যুদ্ধে যান। যুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিতে এখানে বাণিজ্যিক হাসপাতাল হতে পারে না।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০০৮ সালে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান চ’ড়ান্ত পূর্বক ডিসেম্বরে প্রজ্ঞাপন জারী করে। তারই ধারাবাহিকতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বাংলাদেশ গেজেটভুক্ত প্রজ্ঞাপনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-চউক প্রণিত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে সিআরবিকে কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিআরবিকে প্রোটেকটেড এরিয়া হিসেবে সংরক্ষনের নির্দেশ দেয়া হয়। সেই হিসেবে সিআরবিতে কর্মাশিয়াল ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয়া যাবে না।
ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে এটি সংরক্ষণের জন্য রেলওয়ে, চউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সেবাদানকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিআরবিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনা বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ সংবিধান পরিপন্থী কাজের শামিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অন্ধকারে রেখে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আশা করি প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত বিষয়টি জানলে জনস্বার্থ বিরোধী এই প্রকল্প বাতিলে উদ্যোগী হবেন। ডিটেইলড প্ল্যান জোন-৩ এর ৮ অনুসারে সিআরবিকে কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই স্থান সংরক্ষণের জন্য ৮টি নির্দেশনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
উল্লেখিত নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে, সিআরবিতে কোন ভাবেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোন স্থাপনা নির্মাণ বা এপার্টমেন্ট নির্মাণ করা যাবে না। যেহেতু সিআরবি হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত, এর আকৃতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ২৪ ও ১৮ ক রক্ষাকবচ। এছাড়া ২০/১২/২০১৭ তারিখে যে তফসিল দেয়া হয়েছে, সেখানে সিআরবির কথা উল্লেখ ছিল না। বরং বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত হাসপাতালটি চট্টগ্রামে রেলওয়ের কোন এক স্থানে নির্মাণ করা হবে। আমরা সবাই জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অদম্য নেত্রী। তিনি চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবেন।
নিশ্চয় তাঁর কাছে এতদিনে এ বার্তা পৌঁছে গেছে। আশা করি তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন। প্রধানমন্ত্রীকে অনেক কিছু জানানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রীকে যদি সঠিক তথ্য জানানো যায় তাহলে তিনি এ প্রকল্প বাতিল করবেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি। আপনাদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে আমরা সে আবেদনটিই জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন, চবি অধ্যাপক ওমর ফারুক, যুবনেতা হেলাল উদ্দিন, শ্রমিক নেতা আবদুল আহাদ, নারী নেত্রী শাহেলা আবেদীন রীমা, সাংবাদিক ঋত্বিক নয়ন, রাহুল দাশ নয়ন, কামাল পারভেজ, কবি আফম মোদাচ্ছের আলী, প্রিতম দাশ, সুবল বড়ুয়া, যুব নেতা শিবু প্রসাদ চৌধুরী, সাবেক ছাত্রনেতা নূরুল আজিম রনি, রাজনীতিক মিঠুল দাশগুপ্ত, এডভোকেট রাশেদুল আলম রাশেদ, এডভোকেট আমির খসরু চৌধুরী, এডভোকেট জিকো বড়ুয়া, সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম মুন্না, এডভোকেট শাহরিয়ার তানিম, সৌরভ দাশ, এডভোকেট রায়হান, নারী নেত্রী হাসিনা আক্তার টুনু, এডভোকেট আরজু, এডভোকেট তৌহিদুল আলম, এডভোকেট রাসেল সরকার, ছাত্রনেতা মুহমুদুল করিম, মনিরুল ইসলাম, মাইমুল উদ্দিন মামুন, সাইমুন, জিয়াউল হক ইমন, শাহাদাত নবী খোকা, ছাত্রনেতা কায়সার, নাইমুল আবেদীন, এডভোকেট মাহবুবা রহমান শিপু, রাজীব রাহুল, আবৃত্তিশিল্পী দিলরুবা খানম, সজল চৌধুরী, রাজীব চৌধুরী, আর কে রুবেল, সুচিত্রা গুহ টুম্পা প্রমুখ।
















