বান্দরবান: বান্দরবান জেলার বান্দরবানের তমব্রু সীমান্তের বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৫৮ জন সদস্য। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মায়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির সাথে সংঘর্ষের মুখে পালিয়ে এসেছে দেশটির এ সীমান্তরক্ষীরা। তাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবির) ৩৪ ব্যটালিয়নের একটি স্থানীয় তামব্রু ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম। খবর ডয়চে ভেলের।
এ দিকে, রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে সীমান্তের ওই অঞ্চলে গোলাগুলির আওয়াজ আর তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে স্থানীরা।
সীমান্ত লাগোয়া নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের এক নাম্বার ওয়ার্ডের মেম্বার মো. শফিকুর রাহমান রোববার (৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে সাড়েটার দিকে জানান, ‘বিকাল থেকে মায়ানমারে আর গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মায়ানমারের বিজিপির সদস্যরা বাংলাদেশের বিজিবির তামব্রু ক্যাম্পে আছেন। আরাকান আর্মি মায়ানমারে বিজিপির একটি ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বলে আমরা সংবাদ পেয়েছি।’
নাইখংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়াও গেলাগুলির শব্দ রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় আর না পাওয়ার কথা বলেছেন।
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরের পর থেকে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার নাইখংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মায়ানমারে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। গেলাগুলির শব্দ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে শোনা যায়৷ সীমান্ত এলাকার বাড়িতে গুলি ও মর্টার সেল এসে পড়ে। এতে তিন বাংলাদেশি নাগরিক আহত হন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসদুজ্জামান খান কামাল রোববার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে জানান, ‘মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরা আমাদের সীমানর মধ্যে ঢুকে সহযোগিতা চেয়েছেন। তাদের অস্ত্র জমা রেখে মায়ানমারের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আমরা কোন যুদ্ধে জড়াতে চাই না। আমাদের বিজিবির শক্তি সেখানে বৃদ্ধি করেছি; যাতে আমাদেও সীমানায় কেউ ঢুকতে না পারে।’
তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘‘তারা তো তাদের গভর্নমেন্ট ফোর্স। তাদের ফেরত নেবে না কেন? তাদেরকে ফেরত পাঠানোর জন্য পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আলোচনা চলছে।’
এ দিকে, বাংলাদেশে মায়ানমারের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে দেখা করেছেন সচিবালয়ে। পরে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের রেশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাতেও পড়েছে৷ এ ব্যাপারে চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করা হয়েছে।’
স্থানীয় সূত্র বলছে, ১৮ ঘন্টা পর রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকালে আরাকান আর্মি সেখানকার একটি ক্যাম্প (মায়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ ক্যাম্প) দখল করে নেয়ার পর সন্ধ্যায় সেখানে আর গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
ঘুমধুম ইউনিয়নের এক নাম্বার ওয়ার্ডের মেম্বার মো. শফিকুর রাহমানের বাড়ি তামব্রু পশ্চিমকুল গ্রামে। তিনি বলেন, ‘‘রাত তিনটার দিকে আমার বাড়িতে মর্টার সেল পড়ে ওপার থেকে এসে। ওই সময় থেকেই ওখানে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮ ঘন্টা যুদ্ধের পর পরিস্থিতি এখন শান্ত। আমরা শুনেছি, আরাকান আর্মি একটি ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে।’
মো. শফিকুর রহমান জানান ‘আমরা বাড়ি ছাড়াও আরো একটি বাড়িতে মর্টার শেল পড়েছে। দুই বাড়িতে কেউ আহত না হলেও আশপাশ এলাকায় তিনজন আহত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন আতঙ্কে থাকলেও তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়নি। তবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।
রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) ভোর রাত থেকে তামব্রু সীমান্তে অবস্থান করছেন স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম। তার বাড়ি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়।
তিনি বলেন, ‘শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকাল তিনটার দিক থেকেই ওইপাড়ে গুলির শব্দ শোনা যায়। রাতে আরো তীব্র হয়। গুলি ও মর্টারের শেল বাংলাদেশ অংশেও এসে পড়ে। রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকাল থেকে গোলাগুলির শব্দ কমে যায়। আমরা জানতে পেরেছি, বিকাল পর্যন্ত ৫০ জনেরও বেশি মায়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য বিজিবির বাছে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তবে, বিজিবি ১৪ জনের পর আর কিছু জানায়নি। তাদের প্রেস ব্রিফিং করার কথা ছিল তাও করেনি।’
পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। সীমান্তের আশপাশের বাড়িতে পুরুষরা থাকলেও নারীদেও সরিয়ে নেয়া হয়। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের ৩৪ নাম্বার পিলারের ওপারে মায়ানমারের অংশে একটি ক্যাম্প দখল নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মায়ানমারে বিজিপি ও আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকাল তিনটা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, ‘সীমান্ত বিজিবির সদস্যরা দেখছেন। আর নাগরিকদের নিরাপত্তার কোন সমস্যা হলে আমরা দেখব। এখনো তেমন কোন সমস্যা হয়নি।’
আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাতটার দিকে জানান, ‘‘আমরা এখন আর গোলাগুলির শব্দ শুনছি না। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘সীমান্তের লোকজনের জন্য আমরা আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি। তবে, কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আসেননি। কেউ কেউ ওই এলাকা ছেড়ে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে বলে শুনেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেছি। আরো এক দিন বন্ধ থাকবে।’
বাংলাদেশের করণীয়: নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের বর্ডারকে আরো সুরক্ষিত করতে হবে। আর ওখানে (মায়ানমার) কী ঘটছে তার গোয়েন্দা তথ্যের বিষয়ে আমাদের ঘাটতি আছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। তাই, সেই তথ্যের নেটওয়ার্ক আমাদের আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তাহলে, আমরা আগাম ব্যবস্থা নিতে পারব।’
তার কথা, ‘মায়ানমারের ভিতরে যুদ্ধ কতটা বিস্তৃত হচ্ছে, সেটা আমাদের জেনে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, এক বার যদি রোহিঙ্গারা আসা শুরু করে, তাহলে কিন্তু ঠেকানো যাবে না। ২০১৭ সালে আমরা বলেছিলাম আমাদের প্রস্তুতি ছিলে না। এবার যেন সে রকম না হয়।’
‘‘আর আমাদের এ ব্যাপার নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে আসিয়ানের সাথে আমাদের কথা বলতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান জেনে আমাদের কথা বলছে হবে। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর প্রভাব কী পড়ে তাও খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেই ধরনের তৎপরতা আমি দেখছি না এখনো।’
আর মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্টদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, ‘আরাকান আর্মি পালাতেয়া নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এখন বাংলাদেশ-মায়ানমার বর্ডার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। এখন যে যুদ্ধটা হচ্ছে সেটা মূলত আরকান আর্মি ও মায়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে। পালাতেয়া নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ফলে মায়ানমার-ভারত সীমান্ত এরইমধ্যে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।’
তার কথা, ‘মিয়ানমারের ভেতরে আরো বহু জায়গায় যুদ্ধ চলছে। সিটুয়েতে যুদ্ধ চলছে। পুরাতন আকিয়াব বন্দর যেখানে ওটার টাউনশিপের আশেপাশে যুদ্ধ চলছে। ওই সব এলাকায় দুই লাখের বেশি মুসলমান আছে৷ এর পূর্বে, ক্লিনজিং করা হয়েছিল। এখন যদি ফের শুরু হয়, তাহলে বাংলাদেশে কিন্তু তারা চলে আসতে পারে বলে আমার আশঙ্কা।’
‘সীমান্তে বিজিবি মোতায়েনের পরও আরো অনেক জায়গা আছে, পাহাড়ি এলাকা আছে যেখান থেকে মায়ানমারের লোকজন ঢুতে পড়তে পারে। ওইসব জায়গা থেকে সব সময়ই তারা আসা-যাওয়া করে। ২০১৭ সালে এসেছে। এখনো আসা-যাওয়া করছে। ওই গ্যাপগুলো বন্ধ করতে হবে। সেখান থেকে কেউ আসলে তাদেও বুঝিয়ে পুশব্যাক করতে হব।’
এক প্রশ্নের জবাবে এম শহীদুল হক বলেন, ‘আরাকান আর্মি পালাতেয়া দখল করলেও সেখানে চীনের বহু স্থাপনা ও ব্যবসায় আছে। আরাকান আর্মি চীনের কোন স্থাপনায় হামলা চালায়নি। তারা ভারতের স্থাপনায় হামলা করেছে। আরাকান আর্মির সাথেধ চীনের একটা সম্পর্ক আছে। তাই, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিষয়টি নিয়ে চীনের সাথে কথা বলা। তাদের সাথে এটা নিয়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’