‘সোনার সংসার’ নামটি শুনলেই মনে হয় সুখ আর ঐশ্বর্যের গল্প। কিন্তু এই নাটক আমাদের দেখায়, সংসারের আসল সোনা হলো ভালোবাসা, না যে অর্থ। গল্পের কেন্দ্রে দুই ভাই সোহাগ ও আসাদ। বড় ভাই সোহাগ দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে ফেরে একরাশ অর্থ, অহংকার আর অভিমান নিয়ে। অন্যদিকে ছোট ভাই আসাদ থেকে যায় মায়ের পাশে— পরিশ্রমে, ত্যাগে আর ভালোবাসায় গড়া তার জীবন। দুই ভাইয়ের জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ ও সম্পর্কের টানাপোড়েনই গল্পের প্রাণ। মা চান, দুই ছেলে একসাথে সুখে থাকুক; তিনি বলেন—‘সংসার সোনায় নয়, ভালোবাসায় গড়া।’ কিন্তু বাস্তবের কাঁটাঝোপ এসে ভালোবাসার সেই ঘরটাকে ভেঙে দেয়— টাকার গর্ব, স্ত্রীর প্ররোচনা আর ভুল বোঝাবুঝির দেয়াল সংসারকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে।
নাটক ‘সোনার সংসার’ রচনা করেছেন পাপ্পু রাজ এবং পরিচালনা করেছেন ফয়সাল আগুন। চিত্রগ্রহণে ছিলেন শামসুল ইসলাম লেলিন ও হিমেল সরকার। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন আরিয়ান খান শাওন, আর রূপসজ্জায় ছিলেন হাসান মাহমুদ। নাটকের স্থিরচিত্র তুলেছেন সাকিব আহমেদ। সম্পাদনা ও রং বিন্যাস করেছেন মো. রোমজান আলী। আবহ সংগীতের দায়িত্বে ছিল বাংলাই বিডি।
অভিনয়ে ছিলেন তুহিন চৌধুরী, জ্যোতি ইসলাম, আশরাফুল আলম সোহাগ, সাদ্দাম মাল, সাবিনা রনি, খান রোশনী, নাজমুল বাবু, রিপন প্রমুখ।
নাটকটির নির্মাণে বিশেষ ধন্যবাদ জানানো হয়েছে সকাল আহমেদকে।
আবেগের গভীরতা:
গল্পের প্রতিটি দৃশ্যে আবেগের ছোঁয়া আছে। আসাদ, যে ভাই সবসময় মায়ের পাশে থেকেছে, তার নীরবতা ও কষ্ট দর্শকের হৃদয়ে গভীর দাগ কাটে। অন্যদিকে সোহাগের অহংকার, ভুল সিদ্ধান্ত আর পরিণতি জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। যখন মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “তোরা একসাথে থাক, তাহলে আমি শান্তি পাব,” — তখন চোখে পানি না এসে পারে না। নাটকের শেষ দৃশ্যে দুই ভাইয়ের আলিঙ্গন, মায়ের চোখের জল আর সীমাহীন শান্তি — সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়, সংসারের আসল সুখ ফিরে এসেছে ভালোবাসার শক্তিতে।
অভিনয় বিশ্লেষণ:
তুহিন চৌধুরী (আসাদ) ছিলেন নাটকের আত্মা। তার মৃদু কণ্ঠ, নরম অভিব্যক্তি আর সংলাপ বলার সংযমী ধরন চরিত্রটিকে গভীর করেছে। তিনি সেই মানুষটির প্রতীক, যে মায়ের জন্য, ভাইয়ের জন্য, আর সংসারের শান্তির জন্য নিজের অহংকার ত্যাগ করতে পারে। আশরাফুল আলম (সোহাগ) চরিত্রে দুর্দান্ত। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে অর্থের অহংকার ধীরে ধীরে মানুষকে সম্পর্ক থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। শেষে যখন সোহাগ বুঝতে পারে নিজের ভুল, তার কান্না আর অনুশোচনায় গল্প পায় মানবিক গভীরতা।
জ্যোতি ইসলাম (লিমা/আসাদের স্ত্রী) নাটকের সবচেয়ে কোমল অথচ শক্তিশালী নারী চরিত্র। লিমা সংসারের শান্তির প্রতীক— তিনি সবসময় আসাদের পাশে থেকে বোঝান, ‘ভালোবাসা আর সহনশীলতাই সংসারের ভিত্তি।’ তার সংলাপে ছিল সরলতা, কিন্তু সেই সরলতার ভেতরেই ছিল বাস্তব জীবনের কষ্ট আর মমতা। জ্যোতির অভিনয়ে চোখের ভাষা ছিল অব্যক্ত ভালোবাসার দৃষ্টান্ত।
সোহাগের স্ত্রী— গল্পের সবচেয়ে শয়তান মনের চরিত্র। তার মুখে সবসময় মিষ্টি হাসি, কিন্তু কথায় লুকানো বিষ। সে সোহাগকে বারবার ভুল পথে প্ররোচিত করে, ভাইয়ের প্রতি সন্দেহ জাগায়, এমনকি মা’য়ের কথাকেও অবহেলা করে। ‘তুমি এত টাকা পাঠাও, তবুও ওরা তোমার কদর করে না’— এই সংলাপেই বোঝা যায়, সে সংসারের মধ্যে অশান্তির বীজ বপন করছে। তবে নাটকের শেষে তার অনুশোচনা তাকে মানবিকতা ফিরিয়ে দেয়— যদিও ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
সাদ্দাম মাল (শালা চরিত্র) গল্পে প্রাণ এনেছেন। তার সংলাপগুলো বাস্তব, প্রাঞ্জল আর মাঝে মাঝে ব্যঙ্গাত্মক ছোঁয়ায় মজারও। এই চরিত্র নাটকের গতি বাড়িয়েছে, এবং কখনও কখনও বাস্তবতার আয়না হিসেবে কাজ করেছে। সাবিনা ইয়েসমিন (মা) — তিনিই এই নাটকের হৃদয়, আত্মা, ও আলো। তার কণ্ঠের আবেগ, চোখের জল আর শেষের দৃশ্যে ছেলেদের আলিঙ্গনে মুখের হাসি — সবকিছু মিলিয়ে দর্শকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়।
গল্পের উপস্থাপন ও পরিচালনা:
পরিচালক ফয়সাল আগুন একেবারেই বাস্তবধর্মী স্টাইলে এই গল্পকে তুলে ধরেছেন। এখানে কোনো বাড়তি ড্রামা নেই, নেই অপ্রয়োজনীয় সংলাপ— সবকিছু একদম জীবনের মতোই স্বাভাবিক। ক্যামেরার কাজ অসাধারণ। শামসুল ইসলাম লেলিন ও হিমেল সরকার গ্রামের উঠান, ঘরের আলো, বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা আর মায়ের চোখের পানি— সব দৃশ্যকেই বাস্তব করে তুলেছেন। মো. রোমজান আলীর এডিটিং ছিল পরিশীলিত, গল্পের প্রবাহে কোনো বাধা ছিল না। বাংলাই বিডির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক গল্পের আবেগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে— বিশেষ করে ভাইদের ঝগড়া বা পুনর্মিলনের মুহূর্তে সুরগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সব মিলিয়ে ‘সোনার সংসার’ হলো এমন এক নাটক, যেখানে প্রতিটি দৃশ্য জীবনের বাস্তবতা বলে, প্রতিটি সংলাপ সম্পর্কের মূল্য শেখায়।
বার্তা ও শিক্ষণীয় দিক:
নাটকের মূল বার্তা সরল কিন্তু গভীর—‘সংসার সোনায় নয়, মায়ায় গড়া।’ বিদেশের রেমিটেন্স সংসারের ব্যয় চালাতে পারে, কিন্তু সংসারের উষ্ণতা, শান্তি আর ভালোবাসা আসে মায়ের মায়া আর ভাইয়ের বোঝাপড়া থেকে। আজকের সমাজে যেখানে অর্থই সবকিছুর মাপকাঠি, সেখানে ‘সোনার সংসার’ মনে করিয়ে দেয়— পরিবারের ভালোবাসা হারালে কোনো অর্থই সান্ত্বনা দেয় না।
সমাপ্তি:
‘সোনার সংসার’ শুধু একটি নাটক নয়— এটি এক আয়না, যেখানে আমরা নিজেদের পরিবার, সম্পর্ক আর ভুলগুলো দেখতে পাই। শেষে দুই ভাইয়ের মিলন আর মায়ের হাসি— এই দৃশ্য শুধু নাটকের নয়, এটা প্রতিটি পরিবারের আশা, প্রার্থনা আর ভালোবাসার প্রতীক।
সামগ্রিক মূল্যায়ন:
গল্প: ৯.৫/১০, অভিনয়: ৯.৫/১০, আসাদের স্ত্রী (লিমা): ৯/১০, সোহাগের স্ত্রী (নেগেটিভ চরিত্র): ৮.৫/১০, পরিচালনা ও উপস্থাপন: ৯.৫/১০, সংলাপ: ৮.৮/১০, চিত্রগ্রহণ ও মিউজিক: ৯/১০, আবেগ ও বার্তা: ১০/১০ এবং মোট রেটিং: ৪.৮/৫।
দর্শকের অনুভূতি:
‘আমি ইউটিউবে দেখে সত্যিই কেঁদে ফেলেছি। মায়ের চোখের জল, আসাদের নীরবতা, আর সোহাগের অনুশোচনা— সবকিছু এত বাস্তব যে মনে হচ্ছিল নিজের পরিবারের গল্পই দেখছি। শেষে যখন মা বলেন, ‘এটাই আমার সোনার সংসার’, তখন মনে হলো— হ্যাঁ, ভালোবাসাই আসলে সংসারের সোনা।’ তবে আমার মত অনেক দর্শক শেষটা মানতে নারাজ। কেন সোহাগের স্ত্রীকে ক্ষমা করে দেয়া হল! এর কোন ক্ষমা নাই। হয়তো পরিচালক সেকেন্ড পার্টের জন্য তাকে ক্ষমা করিয়েছে। তবে এ হেন সিদ্ধান্ত মানি না মানব না।
শেষ কথা:
ফয়সাল আগুনের ‘সোনার সংসার’ এমন একটি নাটক, যা দেখার পর আপনি শুধু কাঁদবেন না— নিজের পরিবারকে নতুনভাবে ভালোবাসতে শিখবেন।