ফেসবুকের ইনবক্সে একদিন হঠাৎ দেখি—রিজোয়ান রাজন ভাই অনলাইনে। প্রোফাইলের পাশেই সবুজ ডট, মানে উনি ব্যস্ত না! আমি সঙ্গে সঙ্গে লিখলাম—“রাজন ভাই, কেমন আছেন?” উনি হাসির ইমোজি দিয়ে রিপ্লাই দিলেন—“ভালো আছি পায়েল। কালই একটা পারফর্মেন্স ছিল আগ্রাবাদে। আজ একটু বিশ্রামে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম—“পারফর্মেন্স মানে নাটক না গান?” উনি লিখলেন—“না পায়েল, মূকাভিনয়।” আমি অবাক! —“মানে রাজন ভাই, আপনি সেই মাইম করেন? যারা কথা না বলেও গল্প বলে?” উনি হেসে বললেন—“ঠিক তাই। আমরা মুখে না, হৃদয়ে কথা বলি।”
নীরবতার শহরের গল্প:
সেদিন রাতে রাজন ভাইয়ের সঙ্গে কথার শেষ ছিল না। উনি জানালেন, উনার দল ‘প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট’, যারা চট্টগ্রামে নিয়মিতভাবে মূকাভিনয় করে আসছে। বললেন, “পায়েল, চট্টগ্রামে মূকাভিনয়ের চর্চা নিয়মিতভাবে শুরু হয় নব্বই দশকের মাঝামাঝি, ১৯৯৫ সালের দিকে। তখন কিছু তরুণ ভাবল, কথা না বলেও মানুষকে হাসানো বা কাঁদানো যায়। সেখান থেকেই শুরু।” আমি হেসে বললাম—“আর আপনি এখন সেই নীরব বিপ্লবের নেতা?” উনি একটু থেমে বললেন—“নেতা না পায়েল, আমি শুধু একজন অনুশীলনকারী। নীরবতার ভেতর মানুষ খুঁজি।”
প্রথম মঞ্চে নীরব জাদু:
রাজন ভাইয়ের প্রথম পারফর্মেন্সের গল্প শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। উনি বললেন—“চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে প্রথমবার উঠেছিলাম। দর্শক ভর্তি হল। মুখে সাদা রঙ, চোখে ভয়। কোনো সংলাপ নেই। আমি মা-ছেলের গল্প করেছিলাম—যেখানে মা মারা যায়, ছেলে ফুল হাতে বসে থাকে। পুরো হল নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। শেষে দেখি এক মেয়ের চোখে পানি।” আমি লিখলাম—“রাজন ভাই, আপনি তো একদম সিনেমার হিরো!” উনি হেসে লিখলেন—“না পায়েল, আমি শুধু এমন মানুষ হতে চাই, যার নীরবতাও কথা বলে।”
একটু হাসিও আছে:
উনি শুধু সিরিয়াস অভিনয় করেন না। মাঝে মাঝে এমন নাটক করেন যে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়! রাজন ভাই বললেন—“একবার প্রেমিকার বাবার চরিত্রে ছিল এক সহকর্মী। আমি প্রেমিক। ধরা পড়ে গেলাম! বাবা কল্পিত লাঠি নিয়ে মারছে, আমি পালাচ্ছি—দর্শকরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি।” আমি হেসে লিখলাম—“তাহলে তো আপনি চট্টগ্রামের চার্লি চ্যাপলিন!” উনি মজা করে বললেন—“এই উপাধি আমি রাখব!”
সমাজের মঞ্চে নীরব প্রতিবাদ:
রাজন ভাই শুধু মঞ্চে বিনোদন দেন না, সমাজকেও ভাবান। উনি বললেন—“আমরা মাদকবিরোধী, পরিবেশ, নারী অধিকার—এসব বিষয় নিয়ে মূকাভিনয় করি। আমাদের একটা নাটকে দেখিয়েছিলাম, গাছ কেটে মানুষ কিভাবে নিজের শ্বাস বন্ধ করছে।” তারপর যোগ করলেন—“পায়েল, মূকাভিনয় মানে শুধু শরীরের ভাষা নয়, এটা একধরনের প্রতিবাদ—যেখানে শব্দের বদলে চোখ বলে, মুখ বলে, শরীর বলে।”
“আমি মানুষ” — রাজন ভাইয়ের নবধারার বার্তা:
উনার সাম্প্রতিক নাটক “ধর্ম থেকে মানুষ বড়” নিয়ে কথা উঠতেই উনি বললেন—“পায়েল, আমি হিন্দু না, মুসলমান না, বৌদ্ধ না—আমি মানুষ। এই বার্তাটাই আমার শিল্পের মূল। মূকাভিনয় শুধু শরীরের খেলা নয়, এটা আত্মার ভাষা।” আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম—কী অদ্ভুত মানুষ উনি! যেখানে সবাই শব্দে শব্দে লড়ছে, উনি নীরবতাতেই মানুষকে এক করে ফেলছেন।
করোনার সময়ের রাজন ভাই:
আমি বললাম—“রাজন ভাই, করোনার সময় তো সব থেমে গিয়েছিল। তখনও কি মূকাভিনয় করতেন?” উনি একটু গম্ভীর হয়ে লিখলেন—“হ্যাঁ পায়েল, তখন আমি ঘরে থেকেও নীরবতার বার্তা ছড়িয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও করেছি—মানুষকে ভয় নয়, মানবতা শেখাতে। নীরবতাও সাহস জোগাতে পারে, সেটা তখন মানুষ বুঝেছিল।”
আমার উপলব্ধি:
আমি রাজন ভাইয়ের কথাগুলো পড়ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল, এই মানুষটাই যেন আজকের সময়ে সবচেয়ে শান্ত অথচ সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠ। চট্টগ্রামের মানুষ যেভাবে ওনাকে ভালোবাসে, তা শুধু একজন শিল্পী হিসেবে নয়—একজন মানবিক মানুষ হিসেবে। উনার এক লাইন আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে গেল—“কখনো কখনো শব্দ নয়, নীরবতাই সবচেয়ে জোরে চিৎকার করে।”
শেষ দৃশ্য:
রাত তখন প্রায় ১২টা। রাজন ভাই লিখলেন—“পায়েল, এখন যাই, কাল সকালে রিহার্সাল।” আমি মজা করে বললাম—“রিহার্সালে কি আপনি চুপচাপ থাকেন?” উনি হেসে লিখলেন—“চুপ থাকি, কিন্তু ভেতরে একদম শব্দের ঝড় বয়ে যায়।”
চ্যাট শেষ হলো। কিন্তু আমি তখনও ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, এমন একজন মানুষ, যিনি চুপ থেকেও লাখো মানুষের মনে কথা বলেন—তিনি সত্যিই মূকাভিনয়ের কবি।
উপসংহার:
চট্টগ্রামের মূকাভিনয় আমি নিজে দেখি নাই, কিন্তু রিজোয়ান রাজন ভাইয়ের গল্প শুনে বুঝেছি—এটা কোনো সাধারণ শিল্প নয়। এটা এমন এক নীরবতা, যা শব্দের থেকেও বেশি গভীর, যা মানুষের ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তোলে। আজ রাজন ভাই চট্টগ্রামকে বানিয়েছেন বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের রাজধানী। উনার নীরবতা শুধু অভিনয় না, সেটা একধরনের বিপ্লব। আমি কেবল দূর থেকে বলি—“নীরব থাকুন রাজন ভাই, আপনার নীরবতাই এখন আমাদের কণ্ঠ।”