ফুসফুস মানবদেহের শ্বাসকার্যের অঙ্গ। তবে যত্নের অভাবে এই ফুসফুস হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমান করোনা মহামারির কারণে মানবদেহে ফুসফুসের সংক্রমণ বেড়েছে কয়েকগুণ। এমনকি করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও অনেকেরই ফুসফুসের সংক্রমণ রয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা আক্রান্তদের ফুসফুসের যত্ন ও চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী। বিশ্বব্যাপী ফুসফুসের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফুসফুস দিবস পালিত হয়।
ফুসফুসে রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ ধূমপান। এমনকি পরোক্ষ ধূমপানও ফুসফুসের যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধনে সক্ষম। ধূমপানের কারণে ধূমপায়ীদের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের শ্বাসকষ্ট হয়। ধূমপান রক্তে কার্বন মনোঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেনের পরিবর্তে কার্বন মনোঅক্সাইড জমা হয় যা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। ধূমপান হৃদরোগ এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ। সিগারেটের পাশাপাশি ই-সিগারেটও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।
মানবশরীরে বিভিন্ন রোগ থেকে নিরাময় পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে অনেক ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। বিভিন্ন রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সময়মতো ভ্যাকসিন নেওয়া প্রয়োজন। ক্ষতিকারক রোগ ইনফ্লুয়েঞ্জা অথবা নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়ার জন্য প্রতি বছর একবার ফ্লুয়াংক্স/ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন এবং পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন নেওয়া প্রয়োজন। চলমান মহামারির প্রকোপ সামলাতেও মডার্না, ফাইজার, অ্যাস্ট্রোজেনেকা ইত্যাদি বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সরকার কর্তৃক ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি চলছে। কাজেই ফুসফুসকে সক্রিয় ও ঘন ঘন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস জনিত রোগ থেকে দূরে রাখতে ভ্যাকসিন অন্যতম ভূমিকা রাখে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সবারই সচেতন থাকা প্রয়োজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছেন। ফুসফুসের মাধ্যমে অতি সহজেই এই দূষিত বায়ু মানুষকে রোগাক্রান্ত করে ফেলতে সক্ষম। দূষিত বায়ু সেবনের কারণে ফুসফুসে অবস্থিত অগণিত বাতাসের থলি অকেজো হয়ে পড়ে। এর ফলে ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন কারণে বায়ুদূষণ হয়। কল-কারখানা, ইটের ভাঁটা, গাড়ির কালো ধোঁয়া, পল্লী অঞ্চলের লাকড়ির চুলা ইত্যাদি থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম কারণসমূহ। বায়ু দূষণের মাত্রা যেখানে বেশি রোগের মাত্রাও সেখানে অত্যাধিক। কাজেই বায়ু দূষণ সম্পর্কে সকলেরই সচেতন থাকা দরকার।
সুস্থ থাকতে হলে আমাদের নিয়মিত শরীরচর্চা করা প্রয়োজন। শরীরকে সচল এবং সুস্থ রাখার অন্যতম শর্ত হলো শরীরের প্রধান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে অর্থাৎ-ফুসফুস, হার্ট ও কিডনি সক্রিয় রাখা। নিয়মিত ব্যায়াম, শরীরচর্চা এবং নির্মল বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখা সম্ভব। যারা ইতোমধ্যে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত তাদের আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। ফুসফুসের ব্যায়াম/ ব্রিদিং এক্সারসাইজ নিয়মিত করলে শ্বাসপ্রক্রিয়া সচল থাকে।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে মারাত্মক ক্যান্সার হচ্ছে ফুসফুসের ক্যান্সার। এরূপ ক্যান্সারের কারণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুসংখ্যাও বেশি। যদি এই ক্যান্সার প্রাথমিক স্তরে সনাক্ত করা না যায় তাহলে তা নিরাময় কঠিন হয়ে পড়ে। একটি পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ৮০ ভাগ ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীই ধূমপান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর প্রায় ২ মিলিয়ন নতুন ফুসফুসের ক্যান্সারের রোগী ধরা পড়ে এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১.৭৬ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
ফুসফুসের যত্ন নেওয়া এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ফুসফুসের প্রধান রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- সিওপিডি, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, যক্ষ্মা, আইএলডি, লাং ক্যান্সার ইত্যাদি। ফুসফুসের যত্ন নিতে আমাদের ধূমপান বর্জন, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন গ্রহণ, নির্মল বায়ু সেবনের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা এবং ফুসফুসের ব্যায়াম করা উচিত।
লেখক: ডাঃ মোঃ ফজলে কিবরিয়া চৌধুরী
কনসালটেন্ট-রেসপিরেটরি মেডিসিন
এভারকেয়ার হসপিটাল চট্টগ্রাম।
















