কোভিড-১৯ অতিমারি সৃষ্ট অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাওয়া বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের পক্ষে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই ধরনের মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা অনেক দিক থেকেই নাটকীয় হয়ে ওঠে- এটি বলা যেতেই পারে কারণ সময়ের আবর্তে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী এরভিং গফম্যান তাই যথার্থই বলেছেন যে, আপদকালীন অপ্রত্যাশিত সংকট মোকাবেলায় নেতাদের বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
নেতাদের অবশ্যই দেশের সঙ্কটের সময়ে দুটি মূল ভূমিকা পালন করতে হয়। একটি সামনে থেকে আর অপরটি পর্দার অন্তরালে থেকে নেতৃত্ব প্রদান করা। সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদানের সময় নেতাদের অবশ্যই অতিমারি চলাকালীন নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে, তাদের কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা প্রেরণ করতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণা জোগাতে হবে। বিপদের সময় নেতাদের উচিত নাগরিকদের সমবেদনা জানানো এবং বিপর্যয় মোকাবেলায় উৎসাহ প্রদান করা।
দায়িত্ব পালনের সময় নেতাদের অবশ্যই বিনয়ী এবং নম্র হওয়া উচিত। পর্দার পিছন থেকে অতিমারি সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলায় নেতাদের বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তাদের উচিত সংকটকে এমনভাবে মোকাবেলা করা যাতে নাগরিকরা তাদের উপর আস্থা রাখে। অতএব, নেতৃত্বের গুণাবলী কোভিড-১৯ এর মতো অতিমারী সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশ ভেদে বিশাল পার্থক্য তৈরি করতে পারে।
অতিমারির ভয়াবহ পরিণতির কারণে আমরা গত দেড় বছরে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য পরিচালন ব্যবস্থায় বড় ধরনের বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছি। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান রোগী চাপ ও প্রাণহানি মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
করোনা অতিমারি নিয়ে কাজ করার সময় আমরা বিভিন্ন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত ভূমিকার সাক্ষী হয়েছি। একই সাথে, বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের সাফল্যের কাহিনীও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক ভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে করোনাকালে নাগরিকদের জীবন বাঁচাতে ও অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাকিন্ডা কেট লরেল আর্ডারন এর দুর্দান্ত প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক ভাবে অত্যন্ত প্রশংসা পেয়েছে।
এই নেতাদের মতো, দক্ষিণ এশিয়ার একজন নেতা কোভিড-১৯ সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলায় অনুপ্রেরণামূলক নেতা হিসাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২০ সালের মার্চ থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
তাঁর বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের কারণে, অতিমারির নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক রয়েছে। মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে আমরা ভারতকে ছাড়িয়েছি। এমনকি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বড় বড় অর্থনীতির তুলনায় ইতিবাচক রয়েছে। মোট রোগীর সংখ্যাসহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে বেশ কম রয়েছে।
অতিমারী চলাকালীন শেখ হাসিনার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বহু লেখালেখি করেছেন। অতএব, আমি এই বিষয়ে আলোকপাত না করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যে তুলে ধরার চেষ্টা করবো যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রথম বৈশিষ্ট্যে হল দূরদর্শিতা। নেতা হিসেবে সফল হতে হলে একজন নেতাকে সঙ্কটকালীন সময়ে সঙ্কটের প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে আগে থেকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়। তিনি অতিমারীর বিপর্যয়মূলক প্রভাব আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এবং এই বিপর্যয় থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে এবং অর্থনীতির গতিপথকে চলমান রাখতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি লকডাউন কার্যকর করার ক্ষেত্রে এবং অফিস, কলকারখানা এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে প্রত্যেক বারেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এখন পর্যন্ত নাগরিকদের জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পেরেছেন বেশ সফলভাবেই।
শতাব্দীর সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ সময়ে এই জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নেতার পক্ষে সহজ নয়, যেখানে বিপুল সংখ্যার মানুষ দিন আনে দিন খায়। তবে তিনি প্রমাণ করেছেন যে আমরা যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে আমরা যে কোনও সঙ্কটকে কাটিয়ে উঠতে পারি।
এমনকি, তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয়তা অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলেন বিধায় ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন এক সময় যখন বিশ্বের বহু বৃহৎ অর্থনীতি তাদের নাগরিকদের জন্য ভ্যাকসিনের একটি ডোজও সংগ্রহ করতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশ ৩০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি সম্পাদন করে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে।
যদিও ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে টিকা প্রদান প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তবে, সরকার ভ্যাকসিন কেনার জন্য বিভিন্ন বিকল্প উৎসের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট হ’ল তাঁর সততা। আমরা গত ৫০ বছরে দেশে বিভিন্ন সরকার ও নেতাদের শাসন প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা আরও প্রত্যক্ষ করেছি যে বেশিরভাগ নেতা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা অর্থোপার্জনের জন্য দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ পদধারীরা যদি দুর্নীতিবাজ হয়ে পড়েন তা দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়।
তবে শেখ হাসিনা এবং তার নিকটবর্তী পরিবারের সদস্যরা এক্ষেত্রে বেশ ব্যতিক্রমী। এমনকি তাঁর চির প্রতিদ্বন্দ্বীও দাবি করতে সক্ষম হবে না যে তিনি বা তাঁর নিকটতম পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এর অর্থ এই নয় যে দেশে দুর্নীতি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ প্রশাসন, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের একাংশের দুর্নীতি। তবে এটি সত্য যে, তিনি অনেকের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নিয়েছেন।
তাঁর সততা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ নিতে সাহস জুগিয়েছে। এমনকি কোভিড -১৯ অতিমারি চলাকালীন তিনি দুর্নীতিতে জড়িত বলে প্রমাণিত ব্যক্তিদের দণ্ডিত করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হ’ল মানুষের প্রতি অকৃতিম ভালবাসা। বাবার মতো তাঁরও বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা রয়েছে। সুতরাং, তাঁর সরকার অতিমারিকালীন সময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে যথাসম্ভব সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এটা ঠিক যে করোনা অতিমারি থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য লকডাউন কার্যকর করে মাসের পর মাস অভাবী মানুষকে সহায়তা করা বাংলাদেশ সরকার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে, এটাও সত্য যে, সরকার সবচেয়ে খারাপ সময়ে দুঃস্থ মানুষকে যথাসম্ভব সহায়তা করেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য যা তাকে অন্যের থেকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে তা হ’ল সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা। তিনি সবসময় দৃঢ় সংকল্পের সাথে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানেন দেশ পরিচালনার জন্য কোনটি ভাল এবং কোনটি খারাপ সিদ্ধান্ত।
তিনি সবার কথা শোনেন, তবে সিদ্ধান্ত নেন নিজের মতো করে। এটি নেতৃত্বের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য যা একজন নেতাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস ও দূরদর্শিতা তাকে অতিমারি চলাকালীন দেশকে মারাত্মক ক্ষতি ও অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাঁচাতে সহায়তা করেছে।
অতিমারি পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান হিসাবে তাঁর সাফল্য পর্যবেক্ষণ করে, কমনওয়েলথ তাঁকে যথার্থভাবে বিশ্বের তিনজন অনুপ্রেরণামূলক নেতার একজন হিসাবে বেছে নিয়েছে। অতিমারির চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি, তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশাল অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমরা আশা করি আমরা তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি উন্নত দেশের নাগরিক হয়ে উঠব।
লেখক :
ড. প্রণব কুমার পান্ডে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর