হাজার বছর ধরে মানুষ ফল গাছের বংশ বিস্তারে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে। সেটি হলো গাছের জোড় কলম পদ্ধতি।
আধুনিক কৃষিতে সংযোজিত হয়েছে জোড় কলম। কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধির এক ধরনের প্রক্রিয়া যেখানে এক উদ্ভিদের শাখা কেটে নিয়ে অন্য উদ্ভিদে সংযোজন করা হয়। বিভিন্ন উদ্ভিদের বাম্পার ফলন পেতে হলে কলম করে গাছ লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়। গুটি কলম, চোখ কলম ও জোড় কলমের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন বেশ এগিয়ে।
কলম হচ্ছে -“মাতৃগাছের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় এর শাখায় অস্থানিক শিকড় গজিয়ে মাতৃগাছের হুবহু গুণসম্পন্ন চারা উৎপাদনের কৌশল”। অর্থাৎ ইপ্সিত ফলগাছের কোন শাখায় ক্ষত সৃস্টি করে সেখান থেকে আস্থানিক শিকড় গজিয়ে পরবর্তীতে এটিকে মাতৃগাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি পুর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র গাছ হিসাবে তৈরী করা ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ফলের বংশবিস্তারে জোড় কলম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যেমন: লিচু, পেয়ারা, কাগজিলেবু, জামরুল, বাতাবী লেবু, ডালিম, করমচা, গোলাপজাম, জলপাই, কামিনী ফুল, ভেলভেট ফুল ইত্যাদি।
সাধারণতঃ ঝোপ জাতীয় ফল গাছ যেগুলো উচু কম হয় এবং পাশ্বে বেশি ছড়ায় এ ধরণের গাছের বংশবিস্তারের জন্য জোড় কলম উপযোগী।
উপকরণ
এ কলম করতে গ্রাফটিং চাকু, ব্লেড, সিকেচার, পলিথিন ক্যাপ, পলিথিন ফিতা, সুতলী, পরিবেশ সহনশীল একটি ষ্টক গাছের চারা, কাংখিত গাছের ডগা বা সায়ন এবং দক্ষ মালি ইত্যাদি।
কলম করার উপযুক্ত সময়
মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কলম করার উপযুক্ত সময়। কারণ এ সময় বাতাসে আদ্রতা ও গাছের কোষের কার্যকারিতা বেশী থাকে। ফলে তাড়াতাড়ি জোড়া লাগে এবং সফলতার হারও বেশি পাওয়া যায়।
স্টক তৈরি
অনাকাংখিত কিন্তু পরিবেশ উপযোগী গাছের বা স্থানীয় জাতের বীজ হতে চারা তৈরী করতে হবে যাতে কাংখিত জোড়া লাগানো সম্ভব হয়।
স্টক চারা তৈরির ধাপসমুহ
পরিণত গাছ হতে সুস্থ ও সবল বীজ সংগ্রহ করা।
স্টক চারাটি সরাসরি মাটি বা পলিব্যাগে তৈরি করা।
যদি চারাটি মাটিতে তৈরি করা হয় তবে মাটি ভালভাবে কুপিয়ে ঝুরঝুরা করে আগাছা পরিস্কার করে প্রয়োজনীয় জৈব সার মিশিয়ে বেড আকারে করতে হবে। বেডটির প্রস্থ্ যেন ১ মিটার এর বেশি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর পর বেডে ২৫ সেমিঃ পর পর লাইন করে প্রতি লাইনে ২০ সেমিঃ পর পর চারা/ বীজ রোপণ করতে হবে এবং কলম করার পূর্ব পর্যন্ত স্টক চারাগুলোর সকল প্রকার পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।
চারা পলিব্যাগে তৈরি করলে ২০ সেমিঃ x ১২ সেমিঃ পলিব্যাগ নিতে হবে। দোঁয়াশ মাটির সাথে অর্ধেক পচা গোবর ও কম্পোস্ট মিশিয়ে পলিব্যাগ ভরতে হবে।
প্রতি ব্যাগে একটি করে বীজ বা চারা রোপণ করতে হবে। চারা গজানোর পর পলিব্যাগগুলো যেন কাত হয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে অন্যথায় চারার গোড়া বাঁকা হয়ে যাবে।
এবার ব্যাগটি বেডে ২৫ x ২০ সেমিঃ দুরত্বে রোপন করতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে পলিব্যাগটি যেন মাটির সমান্তরালে থাকে। এতে খরা মৌসুমে পানি সেচ কম লাগে এবং চারাটি সুস্থ ও সবল হয়।
সুস্থ, সবল এবং নিরোগ চারা পাওয়ার জন্য আগাছা, রোগ ও পোকা-মারড় দমন করতে হবে। প্রয়োজনে গাছে সার ও সেচ দিতে হবে।
স্টক চারার বয়স ও সায়ন নির্বাচন
আম
স্টক চারাটির বয়স ৯-১২ মাস হবে।
উৎকৃষ্ট ও কাঙিক্ষত মাতৃগাছ থেকে সুস্থ ও সবল সায়ন নিতে হবে।
সায়নটি লম্বায় ১৫-১৮ সেমিঃ হবে।
সায়নটির ডগায় একটি সুপ্ত কুড়ি থাকতে হবে।
সায়নটির রং গাঢ় সবুজ থেকে কালচে সবুজ হবে এবং
সায়নটি সংগ্রহের পর পরই সমস্ত পাতা অপসারণ করে ভিজা ন্যাকড়া ও পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে রাখলে সায়নটির সতেজতা অক্ষুন্ন থাকে।
আমের সায়ন মাতৃগাছে সংযুক্ত থাকা অবস্থায় পাতা কেটে ফেলাকে ডিফলিয়েশন বলে। ১০ দিন পূর্বের ডিফলিয়েশন করা সায়ন দিয়ে কলম করলে তাড়াতাড়ি জোড়া লাগে এবং সফলতার হারও বেশি হয়।
কাঁঠাল
স্টক চারাটির বয়স ২-৩ সপ্তাহ হতে হবে।
সমব্যাস সম্পন্ন ১-২ মাস বয়সের কাঙিক্ষত গাছের ডগা সায়ন হিসেবে নিতে হবে।
সায়নটির শীর্ষ কুঁড়ি কয়েক দিনের মধ্যে বিকশিত হবে এমনটি হতে হবে। যার রং গাঢ় সবুজ কিন্ত টিপ দিলে শক্ত মনে হবে।
সায়নটি সংগ্রহের পর পরই সমস্ত পাতা অপসারণ করে ভিজা ন্যাকড়া ও পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে রাখলে সায়নটির সতেজতা অক্ষুন্ন থাকে।
সায়নটি দৈঘ্যে প্রায় ১০ সেমিঃ হবে।
জলপাই
স্টক চারাটির বয়স ৬-৮ মাস হতে হবে।
পরিপূর্ণ ও বিকশিত এবং কাঙিক্ষত গাছের ডগার শীর্ষ থেকে কচি ১০-১৫ সেমিঃ অংশ কেটে ফেলে দিয়ে নিচের ১৫-১৮ সেমিঃ ডগাটি সায়ন হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
সায়নটি সংগ্রহের পর পরই সমস্ত পাতা অপসারণ করে ভিজা ন্যাকড়া ও পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে রাখলে সায়নটির সতেজতা অক্ষুন্ন থাকে।
পেয়ারা
স্টক চারাটির বয়স ৯-১২ মাস হতে হবে। স্টক হিসেবে পলি পেয়ারার চারা ব্যবহার করলে উইল্ট প্রতিরোধী গাছ তৈরী করা সম্ভব।
পেয়ারা ডালের ডগার কচি অংশে ৪টি ধার/খাজ থাকে। এই ধার বা খাজের ঠিক নিচের গোলাকার অংশটিকে সায়ন হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
সায়নটি লম্বায় ১৫-১৮ সেমিঃ হওয়া ভাল।
সায়নটি সংগ্রহের পর পরই সমস্ত পাতা অপসারন করে ভিজা ন্যাকড়া ও পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে রাখলে সায়নটির সতেজতা অক্ষুন্ন থাকে।
কামরাঙা
স্টক চারাটির বয়স ৬-৮ মাস হতে হবে।
সায়নের ব্যাস স্টক চারার সম আকারের হলে ভাল হবে।
পরিপূর্ণ ও বিকশিত এবং কাঙিক্ষত গাছের ডগার শীর্ষ থেকে ১০-১৫ সেমিঃ কচি অংশ কেটে ফেলে দিয়ে নিচের ১৫-১৮ সেমিঃ ডগাটি সায়ন হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
একটি ডগা হতে একাধিক সায়ন সংগ্রহ করা যেতে পারে।
সায়নটি সংগ্রহের পর পরই সমস্ত পাতা অপসারণ করে ভিজা ন্যাকড়া ও পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে রাখলে সায়নটির সতেজতা অক্ষুন্ন থাকে।