বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতে যাঁরা আপন আলোয় আলোকিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে আশরাফুল করিম সৌরভ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি কেবল অভিনয়ে পারদর্শী নন, বরং একাধারে একজন মঞ্চনির্মাতা, নাট্যকার ও দক্ষ পরিচালক। শিল্পকে তিনি ভালোবেসেছেন হৃদয়ের গভীর থেকে, আর সেই ভালোবাসা দিয়েই গড়ে তুলেছেন নিজের আলাদা পরিচয়।
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক চেতনায় উজ্জীবিত। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্য, গান, নাটক ও অভিনয়ের প্রতি তাঁর অদম্য টান তাঁকে গড়ে তুলেছে এক বহুমুখী প্রতিভা হিসেবে। তিনি স্কুল জিবনেই নাটকের সাথে যুক্ত ছিলেন। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন ক্লাব সংগঠনে বাৎসরিক নাটক ডিরেকশন দেয়া ইত্যাদি।
প্রথম যাত্রা :১৯৯১ সালে মঞ্চমুকুটের মাধ্যমে চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সাথে যাত্রা শুরু হয়। থিয়েটারের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একাধিক নাটকে শতাধিক মঞ্চায়নে অংশগ্রহন করেছেন। তার মধ্যে মহেস্বেতাদেবির ‘চট্টি মুন্ডার তীর, সফদার হাসমী রচিত নাটক ‘লেখা পড়া করে যে’, শুকদেব চট্টোপাধ্যায়ের লিখা নাটক ‘আদাব’, ফরাসি নাট্যকার মলিয়েরের লাভ ইজ দা বেস্ট ডক্টরস্ অবলম্বনে ‘ভালোবাসা কারে কয়’ গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিসের ‘আন্তিগনে’ হেনরিক ইবসনের ডলস্ হাউস অবলম্বনে নাটক ‘পুতুল খেলা’, বিয়ে, রুপেশকান্তি দের ‘হতজ্ঞান’ উল্লেখযোগ্য।
বিটিভিতে অভিনিত নাটক: টেলিফিল্ম দিগন্তের নিমন্ত্রণ, ধরাবাহিক ‘খর কুটোর আক্ষান’ ধারাবাহিক কর্পোরেট, ধারাবাহিক কখনও রোদ কখনও বৃষ্টি, আমাদের শেখ রাশেল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আশরাফুল করিম সৌরভের লিখা মঞ্চনাট: ভণ্ডামি, পাগলের ডাক্তার, একতা, ‘বাঘ সাবধান শিয়াল আসছে’ ইত্যাদি; যা বিভিন্ন ক্লাবের বার্ষিক নাটক হিসাবে মঞ্চায়িত হয়েছে।
এরপর ১৯৯৪-৯৫ দিকে তিনি এলাকায় সংস্কৃতি প্রেমী ফোরকান ও মোরশেদসহ গড়ে তুলেন কুন্তলা সঙ্গীতালয়। সেটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুলকবহরে সঙ্গীত, অভিনয়, আবৃত্তি, গিটার (হাওয়াইন ও স্প্যানিশ), তবলা, চিত্রাঙ্কন দক্ষ প্রশিক্ষকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রায় এক যুগ সফলতার সাথে পরিচালনার পর সকলের ব্যস্থতার কারণে তা তিনি সঙ্গীত ওস্তাদ দুলাল গোস্বামীর দাদার দায়িত্বে ছেড়ে দেন। বর্তমানে তা ছন্দানন্দ নামে পরিচালিত।
১৯৯৬-২০০০ সালের মধ্যে ফিল্ম মেকিং, ডিরেকশন, স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের উপর ঢাকা এবং চট্টগ্রামে একাধিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। ২০০৭-২০১৬ পর্যন্ত চাকুরি এবং পারিবারিক ব্যস্থতার কারণে থিয়েটার অঙ্গনের সকল কার্যক্রম হতে সাময়িক বিরত থাকেন। যার কারণে এই মাঝখানের জেনারেশনটা উনার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। পরবর্তী ২০১৭ সাল হতে পুনরায় অভিনয় ও থিয়েটার জগতে পুরো উদ্দ্যমে ফিরে আসেন। ২০১৭ সালে ৪ মার্চ আ-কার ই-কার চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভিজুয়াল জগতে কাজ শুরু করেন। একাধিক বিজ্ঞাপন চিত্র, তথ্যচিত্র টেলিফল্মের, নাটক, ছোট নাটক বিটিভিসহ বিভিন্ন মিডিয়া, সিএমপি পুলিশ (ট্রাফিক উত্তর ও পশ্চিম জোন) চট্টগ্রামের উদ্যোগে ১০ টির অধিক সচেতনতামুলক ভিডিও চিত্র এবং ডুকুমেন্টরি নির্মাণসহ সব মিলিয়ে মোট দুই শতাধিক ভিজুয়াল নির্মাণ করেন।
এছাড়াও রচনা ও নির্দেশনায় অসংখ্য মঞ্চ নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে দেশের নানা প্রান্তে- থিয়েটার, ক্লাব এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য টেলিফিল্ম ‘অতঃপর দুজন, ‘দহন’ ‘সেকেন্ড এপ্রিল’ ‘জান্নাত’ ‘কালো মেঘের নৌকা’ ‘নোলক’ স্বল্প দৈঘ্য ‘এক রাতের অতিথি’ ‘আশার আলো’ ইত্যাদি।
সিনেমা: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘দামপাড়া’য় একজন পাকিস্তানী আর্মি মেজরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এছাড়া সিনেমা ‘রেড কয়েন” এবং ‘উখিনু’ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।
বিজ্ঞাপন চিত্র: মোস্তফা হাকিম গ্রুপের মুসকান সয়াবিন তেল, রবি এবং ইনোভেটেড লজিস্টিকসের বিজ্ঞাপন চিত্রে অভিনয় করেছেন। এছাড়া তানিম পারভেজের ওয়েভ সিরিজ ‘ছিক্স’-এ তিনি অভিনয় করেন।
তাঁর প্রতিটি নাটকেই তিনি ছুঁয়ে গেছেন দর্শকের হৃদয়, জাগিয়েছেন ভাবনার খোরাক। তাঁর নির্দেশনায় কাজ করার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং শিল্পকে জীবনের অংশ করে নেওয়ার অদ্ভুত এক শক্তি। আশরাফুল করিম সৌরভ কেবল পরিচালক নন, তিনি যেন শিল্পের এক নিবেদিতপ্রাণ সাধক। বর্তমানে তিনি আ কার ই কার চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং সমাজ ও জীবনের বাস্তবতাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চিনতে শেখায়। অভিনয় শিল্পে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক যাদুকরী বিপ্লব, যা তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে নতুন পথে হাঁটার।
আশরাফুল করিম সৌরভ কেবল একজন নাট্যকার বা পরিচালক নন, তিনি এক সাংস্কৃতিক আলোকবর্তিকা। তাঁর শিল্পচর্চা, সৃজনশীলতা ও জীবনদর্শন আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য হয়ে থাকবে এক উজ্জ্বল দিশারী। তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের গৌরব, যাঁকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এবং করবো আজীবন। তিনি বর্তমানে মঞ্চ মুকুট নাট্য গোষ্ঠী ও চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সদস্য।