চট্টগ্রামের বাতাসে যখন সমুদ্রের লোনা গন্ধ মিশে থাকে, সেই বাতাসের ভাঁজেই কোথাও মিশে থাকে মঞ্চের ধুলোর গন্ধ-অদৃশ্য এক ঘ্রাণ, যা বোঝে কেবল সেইসব মানুষ, যারা শব্দ দিয়ে নয়, নীরবতায় কথা বলতে জানে। সেই নীরবতার মাঝেই এক উচ্চারণ, এক অচেনা স্বর- ম. সাইফুল আলম চৌধুরী।
তিনি কেবল একজন অভিনেতা নন। তিনি অনুবাদকের পাণ্ডুলিপি হাতে ধরা এক কবি, নির্দেশকের নরম কণ্ঠে উচ্চারিত দৃশ্যভাবনার জাদুকর, এক শিক্ষক, এক দার্শনিক, এক জননাট্যচেতনার পুরোধা। তাঁকে জানার আগে জানতে হয় মঞ্চকে, আর মঞ্চকে জানতে হলে চোখ বুঁজে শুনতে হয় এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর, যা বলে- ‘তুমি তো ব্রুটাস!’
এই কণ্ঠ, এই সংলাপ, এই শিরশিরে শীতলতা যে মানুষটির মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে নেমে আসে, তিনি চট্টগ্রামের সেই নিঃশব্দে জ্বলতে থাকা বাতিঘর- ম. সাইফুল আলম চৌধুরী।
বাংলা নাটকের ইতিহাসে কেউ কেউ কথা বলেন খুব বেশি, কেউ কেউ বলেন একেবারে কম, আর কেউ কেউ বলেনই না- শুধু থেকে যান। ম. সাইফুল আলম চৌধুরী সেই ‘থেকে যাওয়া’র মানুষ। তাঁর কথা উচ্চারিত হয় সংলাপের মধ্য দিয়ে, তার বেশি নয়। তাঁর নীরবতা অনেক সময় অ্যান্টনির বক্তৃতার চেয়েও অধিক উচ্চগ্রামে বাজে। ‘জুলিয়াস সিজার’ যখন বাংলায় অনূদিত হয় তাঁর হাতে, তখন সেটা আর অনুবাদ থাকে না, সেটা হয়ে ওঠে এক আত্মীয়তা- যেন রোমের রাজনীতি আর বাংলার অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য কোনো দূরের গল্প নয়, বরং এক মেলানো আয়না। আর সেই আয়নার কাচে আমরা দেখি আমাদের নিজেদের মুখ- কখনো শাসকের, কখনো বশ্যতার, কখনো ষড়যন্ত্রের। তাঁর অনুবাদ আমাদের কেবল গল্প দেয় না, দেয় প্রশ্ন। তাঁর নাট্যভাষ্য কেবল চরিত্রের নাম বদলায় না, বদলায় চেতনার মুখাবয়ব।
তিনি যখন মঞ্চে হাঁটেন, দর্শকরা শব্দ শোনে না, হেঁটে যাওয়া শোনে। মঞ্চ যেন একটা পবিত্র জমিন হয়ে যায় তার পায়ের নিচে। সেখানে শব্দ নয়, উচ্চারণের ছায়া থাকে। চরিত্র তার কাছে শুধু মুখস্থ সংলাপ নয়-একটা অস্তিত্ব, একটা গভীর বিশ্বাস। ‘ব্রুটাস’ যখন নাটকে বলে, “ইট ইজ নট দ্যাট আই লাভড সিজার লেস, বাট দ্যাট আই লাভড রোম মোর’- তখন ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর অনুবাদে সেটি দাঁড়ায়- ‘সিজারকে আমি কম ভালোবাসিনি, রোমকে বেশি ভালোবেসেছি।” এই যে সজীবতা, এই যে নিজস্ব টান, এটাই তাঁর শিল্পের শক্তি। শব্দ তার কাছে অভিধানের চেয়ে বড়। তাই তো তিনি ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হয়েও বাংলা শব্দের মায়া ছাড়তে পারেননি। তার অনুবাদে বাংলা ভাষা যেন আবার শুদ্ধ, আবার পবিত্র।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ তাঁর পেশাগত ঠিকানা। কিন্তু থিয়েটার ছিল তাঁর প্রার্থনার মন্দির। অনেকেই শিক্ষকতা করেন, আবার অনেকে নাট্যচর্চা করেন- কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যারা শিক্ষা আর শিল্পকে এক করে দেন, বিনিসুতোর মতো গেঁথে ফেলেন বিদ্যা আর ভাবনার ক্যানভাস। শ্রেণিকক্ষে তার বক্তৃতা যেন কোনো নাটকের পটভূমি। একজন শিক্ষার্থীর কাছে তিনি কেবল অধ্যাপক নন, বরং একজন চরিত্র, যাকে দেখে শেখা যায় ‘মঞ্চে কিভাবে বাঁচা যায়’। তিনি তাঁর ছাত্রদের নাটকের মতোই দেখেছেন—ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছেন, দৃশ্যবিন্যাসে সাজিয়েছেন, সংলাপ শিখিয়েছেন, তারপর ধ্বনিত করেছেন- ‘এগিয়ে যাও, সময় তোমার প্রতিপক্ষ নয়, বন্ধু।’
যে শহরের নাম চট্টগ্রাম, তার রাস্তায় রিকশার চাকার শব্দের সাথে কোথাও কোথাও মিশে থাকে আলকাতরার মতো ঘন নিঃশ্বাস- সেই নিঃশ্বাসে নাটকের ধোঁয়া। ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর শিল্পচর্চা এই শহরের রক্তে ঢুকে গেছে নিঃশব্দে। গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলেছেন নাট্যচর্চার এক আত্মমগ্ন পরিসর। সেখানে নেই ঢাকার নাট্যচর্চার ফাটাফাটি প্রতিযোগিতা, নেই মিডিয়ার চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন- আছে কেবল নিভৃতে গড়া এক ‘মঞ্চবিশ্বাস’। নাটক তার কাছে কখনোই প্রদর্শন নয়, সেটা আত্মপ্রকাশ- যে আত্মা শব্দে নয়, দৃশ্যে প্রকাশ পায়। সেজন্যই তাঁর নির্দেশনায় নাটক ‘ঘটে’ না, নাটক ‘ঘুমিয়ে উঠে’ দর্শকের মনে।
বাংলা সাহিত্যে যেমন আমরা দেখি সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, যেমন দেখি হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পে নীরব হাহাকার- তেমনি ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর নাটকে দেখি ‘নাট্য সাহিত্যের নীরব চিৎকার’। তাঁর অনুবাদে শব্দ শুধুমাত্র ভাষা নয়, তা একেকটা ইতিহাস, একেকটা সময়ের দলিল। তিনি যখন শেক্সপিয়রের নাটক বাংলায় রূপ দেন, তখন শুধু ভাষার রূপান্তর হয় না, তখন রূপান্তর হয় সময়ের, সমাজের, ক্ষমতারও। যেন রোমান রিপাবলিকের পতন আজকের গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে দিচ্ছে।
এটা কেবল অনুবাদ নয়, এটা এক সাহস- যে সাহস কেবল একজন শিল্পীরই থাকে। যে শিল্পী চোখে তাকিয়ে বলতে পারে, “নাটক এখনো বেঁচে আছে।’ এবং হ্যাঁ, তিনি বেঁচে আছেন। কোনো পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রয়াত কিংবদন্তি নন তিনি। তিনি এখনও জীবিত। এখনও কাজ করছেন। নাটকের পর নাটক তৈরি করে চলেছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই জীবিত কিংবদন্তিকে নিয়ে আলোচনা নেই। যেন আমরা বুঝতেই পারিনি আমাদের মাটির নিচে কী অসম্ভব এক আগ্নেয়গিরি ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই লেখাটির উদ্দেশ্য তাই তাঁকে স্মরণ নয়, বরং তাঁকে উপলব্ধি করা। যেন আমরা বুঝতে পারি, কেবল ঢাকা নয়- বাংলা থিয়েটার বহে চলে চট্টগ্রামেও, আর সেই স্রোতের অগ্রনায়ক হলেন এই সাইফুল আলম চৌধুরী।
আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে একটি কথা বলা জরুরি- ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর নাট্যজীবন কেবল চরিত্র দিয়ে নয়, প্রশ্ন দিয়ে নির্মিত। তিনি নিজেই এক অনির্বাণ প্রশ্ন। যে প্রশ্ন আমাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়- “আমরা কেন থিয়েটারে যাই?” সেজন্যই তিনি একজন সময়স্রষ্টা। তাঁর অনুবাদ এক নব সময়ের দরজা খুলে দেয়, তাঁর নির্দেশনা আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করায় আমাদেরই। আমরা কাঁদি, হাসি, ভয় পাই, বিদ্রোহ করি- আর বুঝি, থিয়েটার এক পলিটিকাল আর্ট, আর্ট ফর লাইফ, আর্ট ফর রেজিস্টেন্স।
এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। এখানেই তিনি মঞ্চের কাহিনিকার নন, জীবনযাত্রার দলিলকার।
বাংলা সাহিত্যে যেমন কয়েকটি নাম চিরস্থায়ী- তেমনিভাবে বাংলা থিয়েটারে ম. সাইফুল আলম চৌধুরী এক অনুচ্চারিত কিংবদন্তি। তাঁর কথা আমরা বইয়ে পাই না, পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখি না, কিন্তু যাঁরা মঞ্চ ভালোবাসেন, তাঁরা জানেন- চট্টগ্রামের সেই নীরব মানুষটি কেমন করে শব্দহীন সংলাপে জীবনের পরতের পর পরত খুলে দেন।
ম. সাইফুল আলম চৌধুরী থিয়েটারকে শুধুমাত্র শিল্প করেননি, করেছেন আরাধনা। তাঁর কাজ, তাঁর উপস্থিতি, তাঁর অনুবাদ, তাঁর নির্দেশনা, সবকিছু মিলে তিনি হয়ে উঠেছেন এক অলিখিত গ্রন্থ- যা এখনো রচিত হচ্ছে, এখনো পাঠ করা হচ্ছে, এখনো সমাপ্ত হয়নি। আমরা কেবল অপেক্ষা করতে পারি- আরও একটি সংলাপের, আরও একটি দৃশ্যের, আরেকটি নিরব উচ্চারণের। “মঞ্চের আলো নিভে গেলে, কিছু মানুষ থেকে যান মঞ্চের সুগন্ধে। ম. সাইফুল আলম চৌধুরী সেই সুগন্ধের নাম।”