শিল্পের মধ্যে থেকেও শিল্পের ঊর্ধ্বে উঠতে জানা এক মানুষ। নাটকের আলো অনেক সময়েই পড়ে কেন্দ্রমঞ্চে, মুখ্য চরিত্রে, কিংবা সংলাপে। অথচ সত্যিকারের আলো অনেক সময় তৈরি হয় নেপথ্যে- চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার উষ্ণতা ও দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে শিল্পে, চিন্তায়, মননে। মুনির হেলাল ঠিক তেমন একজন আলোর কারিগর- তিনি এখনো এই আলো জ্বালিয়ে চলেছেন, নীরবে, আত্মস্থভাবে, শুদ্ধচিত্তে। তাঁর কাজ, উপস্থিতি, চিন্তা আর দর্শন আজও নাট্যচর্চার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁকে নিয়ে কথা মানেই শুধু অতীত স্মরণ নয়- এটি বর্তমানকে চিনে নেওয়া এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দরজা খোলা।
চট্টগ্রামের থিয়েটার আন্দোলন: মাটি থেকে মানুষের দিকে যাত্রা:
বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় চট্টগ্রাম কখনো কেন্দ্র ছিল না- তবে কেন্দ্রকে পাল্টে দেওয়ার শক্তি ছিল। ষাট ও সত্তরের দশকে এখানে যে নাট্য-আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, তা সাংস্কৃতিক পরিসরে একরকম বিপ্লব। সেই আন্দোলনে রাজনীতি ছিল, সমাজচেতনা ছিল, আর ছিল শিল্পের গভীর মানবিক পাঠ।
এই জায়গাটিতেই মুনির হেলাল স্যার নিজেকে স্থাপন করেন না- বরং গড়ে তোলেন। তিনি এই মাটিকে ভালোবাসেন, এই শহরকে থিয়েটারের একটি প্রান্ত নয়, প্রাণ মনে করেন। তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রামের নাট্যচর্চা একাত্ম হয়ে আছে।
অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়: একটি চলমান সংলাপ:
‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়’ কেবল একটি দল নয়- এটি একটি দর্শনচর্চার পরিসর, একটি অনুভবের অঙ্গন। মুনির হেলালএই দলের শিকড়ের কাছে দাঁড়িয়ে, গাছটিকে বড় করেছেন, ফুল-পাতা-ছায়া সবই ছড়িয়েছেন, কিন্তু নিজে কখনো ফুল দাবি করেননি। তিনি এখনো অরিন্দম-এর সঙ্গে আছেন, নিয়মিত নির্দেশনা দেন, পাঠ তৈরি করেন, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে মিশে যান। দল তাঁর কাছে কেবল প্রযোজনা নয়- তাঁর কাছে এটি ‘সমষ্টির আত্মচর্চা’।
নাটক নয়, নাট্য-জীবন:
তিনি কখনো ‘নাট্যজীবন’ শব্দ ব্যবহার করেন না। তাঁর জীবন নিজেই নাট্য হয়ে উঠেছে। নাটক তার কাছে কেবল মঞ্চস্থ নয়- এটি একটি জীবনদর্শন, একটি নৈতিক বিন্যাস, একটি ভাবনা তৈরির পদ্ধতি। আজও, তাঁর প্রতিটি দিন জড়িয়ে আছে নাটকের সঙ্গে। তিনি নতুন নাটকের ভাবনায় থাকেন, নিয়মিত রিহার্সাল করেন, প্রশিক্ষণ দেন, বিশ্লেষণ করেন- কাজ চলছে, এবং ক্রমাগতই নতুন হয়ে উঠছে।
নাট্যভাবনা: মানবিক দৃষ্টি, সামাজিক দায়:
মুনির হেলালের ভাবনায় নাটক কখনো বিচ্ছিন্ন এক শিল্প নয়। তিনি বিশ্বাস করেন, নাটক মানে সমাজের প্রশ্ন তোলা, ব্যক্তি আর সমষ্টির সম্পর্ক পুনরায় আবিষ্কার, শেকড় ছুঁয়ে দেখা। তাঁর নির্দেশনায় বারবার উঠে আসে- মানবিক অধিকার, নৈতিক দ্বন্দ্ব, আত্মদর্শন, শ্রেণিসংগ্রাম, নারী ও প্রান্তিক মানুষের অভিব্যক্তি। তাঁর কাজ এখনো এই ধ্যানের মধ্যেই প্রবাহিত হয়। তিনি নাট্যকারকে পাঠ করেন গভীরভাবে, সংলাপের আড়ালে মানুষের ভাষা খুঁজে পান।
নির্দেশনা তাঁর কাছে একটি দর্শনচর্চা:
রিহার্সাল মানেই তাঁর কাছে কোনো প্রস্তুতি নয়- এটি একটি প্রশ্নমুখর অনুশীলন। তিনি আজও শিল্পীদের বলেন, “সংলাপ মুখস্থ করো না, চরিত্র বুঝো। নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখো তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে।”
নাটক তাঁর হাতে গড়ে ওঠে ধাপে ধাপে- দর্শনীয় বিশ্লেষণ, মঞ্চ-পরিকল্পনার রূপরেখা, আলো ও ছায়ার কাব্যিক ব্যবহার, নিঃশব্দের ভেতরে উচ্চারণ খোঁজা, এই পদ্ধতিতে নির্দেশনা মানে শিল্পীর আত্ম-উন্মোচন। আর এইসব আজও ঘটছে তাঁর প্রতিটি নির্দেশনায়- নতুন নাটক হোক বা পুরনো ক্লাসিকের পুনর্নির্মাণ।
শিক্ষকের চেয়ে অনেক বড় একজন পথপ্রদর্শক:
মুনির হেলাল এখনো প্রতিনিয়ত কাজ করছেন তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে। তিনি শিক্ষক নন- তিনি পথপ্রদর্শক। তিনি নিয়মিত কর্মশালা চালান, নাট্যপাঠ তৈরি করেন, নতুনদের প্রশ্ন করতে শেখান। তাঁর ছাত্ররা বলেন, “স্যার এমনভাবে বোঝান, যেন চরিত্র আমার শরীরে নয়, চিন্তায় বসে যায়।”
তিনি শেখান- “অভিনয় মুখ নয়, মন দিয়ে করো।” “ভবিষ্যৎ ভাবো, কিন্তু শিকড় ভুলে যেও না।” “নাট্যদল মানে পরিবার নয়, দায়িত্ব।”
সম্মাননা নয়, প্রাপ্তি মানুষের বিবেকে:
২০১৮ সালে তিনি পেয়েছেন ‘জিয়া হায়দার নাট্য পুরস্কার’। কিন্তু তিনি একটুও বদলাননি। আজও যেমন ছিলেন- তেমনি বিনয়ী, তেমনি মনোযোগী। বক্তৃতা না দিয়ে কাজকে কথা বলার সুযোগ দেন। তাঁর কাছে শিল্পী হওয়া মানে মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকা, নাটক দিয়ে সামাজিক আলাপ তৈরি করা।
তিনি বলেন না, “আমি কাজ করেছি”। তিনি বলেন, “আমরা কাজ করছি। এখনো করছি। কাজ থেমে নেই।”
উত্তরাধিকার ও উত্তরসূরি: উত্তর-নাটকের নির্মাতা-
মুনির হেলালের সবচেয়ে গভীর প্রভাব দেখা যায় প্রজন্মে। তাঁর হাতে গড়া বহু নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যকর্মী আজ বাংলাদেশের নানা প্রান্তে আলো ছড়াচ্ছেন। তাঁরা কাজের ফাঁকে বলেন- “হেলাল স্যারের রিহার্সাল মানেই একেকটা জীবনচর্চা।” তাঁর প্রেরণায় গড়ে উঠেছে পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, নাট্যকর্মশালা। তিনি নতুন দলকে উৎসাহ দেন, সহযোগিতা করেন, পরামর্শ দেন। তাঁর চোখে এখনো অরিন্দম, নাট্যজন, মঞ্চ, পাণ্ডুলিপি- সবই ততটাই আপন, যতটা ছিল চার দশক আগে।
যাঁরা ইতিহাসকে শুধুই অতীত হতে দেন না:
মুনির হেলাল কোনো অতীত স্মৃতিচারণা নন- তিনি জীবিত ইতিহাসের বহমান অংশ। তিনি এখনো কাজ করছেন, এখনো গড়ছেন, এখনো প্রতিদিন শিখছেন এবং শিখাচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে কথা বলা মানে, আজকের থিয়েটারকে বোঝা, আগামী নাট্যদুনিয়ার খসড়া লেখা। এই লেখার প্রতিটি শব্দ তাঁর প্রতি একটি বিনম্র কৃতজ্ঞতা- শুধু শিল্পের প্রতি নয়, একজন মানুষের নিষ্ঠা, শুদ্ধতা এবং ধৈর্যের প্রতি শ্রদ্ধা। তাঁর নির্দেশনায় আলাদা কোনো ‘অভিনয়’ নেই- তাঁর কাজ আমাদের শেখায়, জীবনকে শিল্প করে তুলতে হলে প্রথমে মানুষের মতো মানুষ হতে হয়।