অভ্র বড়ুয়া: প্রাচীন ভারতের শিল্প, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার অমর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এক অনবদ্য শৈল্পিক নৃত্যশৈলী ভরতনাট্যম। এটি কেবল নৃত্য নয়, বরং ভাষা,সাধনা ওি আত্মদর্শনের পথ। এই নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গিমা যেন রচনা করে জীবনের এক অনুপম কবিতা যার মধ্যে ছন্দ, রাগ, অভিব্যক্তি আর অন্তর্দৃষ্টি মিলেমিশে হয়ে ওঠে ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার এক অপরূপ সংলাপ। ভরতনাট্যমের জন্ম তামিলনাড়ুর মন্দির চত্বরে, প্রাচীন দেবদাসীদের মাধ্যমে। এই নৃত্য ছিল মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে এক নিবেদন ও ধ্যান। নট্যশাস্ত্র ও ভাববিপ্রকাশ অনুসারে, এটি ছিল মূলত ‘পঞ্চম বেদ’ নৃত্যের মাধ্যমে ভগবানের লীলা ও দর্শন পরিবেশনের এক চূড়ান্ত মাধ্যম বলে যা আখ্যায়িত হয়েছে।
সেই যুগে, নৃত্য ছিল পূজা। সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়ের সংমিশ্রণে তৈরি হত এক অলৌকিক পরিবেশ। যেখানে দর্শক শুধু দর্শক থাকতেন না তাঁরাও হয়ে উঠতেন অনুভূতির একাত্মসঙ্গী।
ভরতনাট্যম গঠিত হয়েছে তিনটি মূল স্তম্ভে:
নৃত্ত: বিশুদ্ধ ছন্দ ও অঙ্গচালনার নির্ভর।
নৃত্য: যেখানে অভিব্যক্তির মাধ্যমে কাহিনি চিত্রিত হয়।
নাট্য: যেখানে নাটকীয়তা, মুখাভিনয় ও ভাসার প্রকাশ ঘটে।
এই নৃত্যে প্রতিটি চোখের দৃষ্টি, আঙুলের রেখা, কপালের ভাঁজ, হাঁটার তালে তালে ঘটে যায় এক অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ। মুখে এক অভিব্যক্তি, আর অন্তরে এক অনুভব।
বর্তমানে ভরতনাট্যম শুধু মন্দিরের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এক বৈশ্বিক শিল্পরূপে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের শহর ও গ্রামেও এর অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ চলছে। অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ভরতনাট্যমকে নৃত্যচর্চার অংশ করেছে। তবে তার পরেও বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বহু স্থানে এই নৃত্যশিল্পের পরিকাঠামো অনুপযুক্ত, নৃত্যশিল্পীরা পর্যাপ্ত সহায়তা পান না। অথচ ভরতনাট্যমের মত একটি শাস্ত্রীয় নৃত্য শুধুমাত্র শিল্প নয়, এটি জাতিসত্তার এক জীবন্ত রূপ।
প্রশংসনীয় বিষয় হল বাংলায় ভরতনাট্যম শিক্ষার প্রতি ঝোঁক গত এক দশকে বিশেষভাবে বেড়েছে। কলকাতার অনেক প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও গুরুকুল আজ ভারতের দক্ষিণের এই নৃত্যরূপকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলার শিল্পীরা এতে এনে দিয়েছেন, তাদের নিজস্ব স্পর্শ রবীন্দ্রনাথের গান, বাংলা কবিতার ছন্দে ভরতনাট্যম পরিবেশন আজ আর নতুন বিষয় নয়।
এই নৃত্যরূপ আমাদের শেখায় জীবন মানে শুধুই ব্যস্ততা নয়, মেকি সফলতা নয়, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যদি আমরা কিছু অনুভব করি, কিছু নিবেদন করতে পারি তবেই আমরা সত্যিকারের জীবিত ও জীবন স্বার্থক। ভরতনাট্যম শিল্পীদের চোখে সে জীবন এক পদক্ষেপে ধ্যান, এক অঙ্গচালনায় উপলব্ধি, আর এক ছন্দে মুক্তি।
ভরতনাট্যম হল সেই আয়না, যেখানে আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া শেকড়কে খুঁজে পাই। এই নৃত্যের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি অভিব্যক্তি আমাদরে উপলব্ধি করায় যে নীরব থেকেও অনেক কিছু বলা যায় এবং হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতিও প্রকাশ করা যায়, যদি তা হয় ছন্দে, অনুভবে ও নিবেদনে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ, সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র পরিচালনা বিভাগ, গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত (আইসিসিআর বৃত্তিপ্রাপ্ত)