দুই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস দেশের ৪৯০তম কনিষ্ঠ উপজেলা চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে। উপজেলা ঘোষণার সাড়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যেখানে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে সাধারণ মানুষজন। উপজেলার বেশির ভাগ মানুষই হতদরিদ্র কৃষক, জেলে ও শ্রমিক। ফলে অসহায় ও দরিদ্র মানুষ অন্যত্র গিয়ে চিকিৎসা নিতে না পেরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন।
করোনাকালীন এই কঠিন সময়ে কর্ণফুলীর মানুষ না পারছে করোনা টিকা নিতে, আবার করোনার লক্ষণ থাকলেও যথাসময়ে করোনা টেস্ট করতে না পারায় রোগী সনাক্ত করতেও দেরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই এই একটি অজুহাতেই কোনো ধরনের সেবা পাচ্ছে না উপজেলার দু’লক্ষাধিক মানুষ। বিকল্প ব্যবস্থাও নেই তেমন চোখে পড়ার মতো।
করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্যসেবা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটা অবশ্য সবারই জানা। হাতে গোনা দু’একটি সামাজিক সংগঠন ছাড়া উপজেলার দু’লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় কেউ এগিয়ে আসছেন না। আবার জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই নিরুপায়। যা দরিদ্র ঐ সকল পরিবারের জন্য বোঝাস্বরূপ। অথচ উপজেলা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই এই উপজেলাবাসীর একটি মাত্র দাবী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের।
যাতে করে উপজেলার অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মরতে না হয়। এদিকে রোগীর চিকিৎসার জন্য পাশের উপজেলা আনোয়ারা-পটিয়া দৌঁড়াতে হয় ৩০/৩৫ কিলোমিটার দূর। যা অনেক সময় গভীর রাতে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু জনপ্রতিনিধিগণ বার বার সাধারণ মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিলেও দীর্ঘ পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও দেখা মেলেনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।
সাধারণ মানুষের দাবি, শুধু রাস্তাঘাট উন্নয়ন নয়, মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম স্তম্ভ চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। কিন্তু উপজেলাবাসীর সেই আশার আলো যেন জ্বলছেইনা। ফলে, নিরুপায় হয়ে হাঁতুড়ে ডাক্তার, ওঝা ও ফকির-কবিরাজের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে দৌঁড়ে উপজেলার অনেক রোগীরা।
এখানকার অনেক শিশুরা বিভিন্ন প্রতিষেধক টিকা ও ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাঁরা প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক প্রসূতি মা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে নিজের জীবনও দিচ্ছেন প্রায়ই। কেননা রাতে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না।
যদিও পুরো উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের ১২টি কমিউনিটি ক্লিনিকেই মানুষের ভরসা। যথাক্রমে-জুলধা ইউনিয়নে আবদুর শুক্কুর কমিউনিটি ক্লিনিক, পশ্চিম চরলক্ষ্যা মৌলভীপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক, ডাঙ্গারচর কমিউনিটি ক্লিনিক, জুলধা কমিউনিটি ক্লিনিক, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে শাহ সমিয়া নগর কমিউনিটি ক্লিনিক, খোয়াজনগর হযরত আবদুল জলিল (রা) কমিউনিটি ক্লিনিক, বড়উঠান ইউনিয়নে দৌলতপুর কমিউনিটি ক্লিনিক, শাহমীরপুর কমিউনিটি ক্লিনিক, দক্ষিণ শাহমীরপুর হাজী শের আলী কমিউনিটি ক্লিনিক, শিকলবাহা ইউনিয়নে শিকলবাহা কমিউনিটি ক্লিনিক, ইসহাক মেম্বার কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিকলবাহা আবদুর রহমান কমিউনিটি ক্লিনিক।
এসব ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি) করোনাকালীন সময়ে সেবায় বেশ জোরালো ভূমিকা রেখে চলেছেন। প্রতিদিন তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। কভিড কালীন সময়ে আগের চেয়ে তিনগুন রোগী প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে হাজির হয়ে চিকিৎসা ও ফ্রি ওষুধ নিচ্ছেন বলে জানালেন ডাঙ্গারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি শাহিন আক্তার।
উপজেলা এনজিও সমন্বয়ক মো. ওসমান হোসাইন বলেন, ‘উপজেলায় হাসপাতাল না থাকায় অনেক মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন না এবং অকালে মৃত্যুবরণ করছে গর্ভবতীসহ গরিব মানুষ। অতিদ্রুত হাসপাতাল নির্মাণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।’
বড়উঠান এলাকার মোঃ জানে আলম জানান, ‘আমাদের কর্ণফুলীতে কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই। আমাদের সাধারণ চিকিৎসা নেওয়ার জন্যই ছুটতে হয় দূর দুরান্ত, চাইলে উপজেলায় স্বনামধন্য ব্যক্তি কিংবা জনপ্রতিনিধিরা এই করোনা কালীন সময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবর্তে একটি অস্থায়ী স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করতে পারেন।’
শিকলবাহা এলাকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ‘আমাদের উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হওয়া অতি জরুরি, আমাদের চিকিৎসা নিতে ছুটতে হয় পটিয়া, আনোয়ারা কিংবা শহরে, অথচ এই সময়টা খুব কঠিন। এই সময়ে ছুটাছুটি করা খুবই কষ্টদায়ক, তাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যতদিন না হয় ততদিন পর্যন্ত কিংবা অনন্ত এই করোনা কালীন সময়ে উপজেলা অস্থায়ী একটি চিকিৎসা সেবার খুবই প্রয়োজন।’
প্রসঙ্গত, এই উপজেলাটি ২০১৬ সালের ৯ মে পটিয়া উপজেলার বড়উঠান, শিকলবাহা, জুলধা, চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা এই ৫ টি ইউনিয়ন নিয়ে স্বতন্ত্র কর্ণফুলী উপজেলা গঠিত হয়। এই উপজেলা গঠন করার প্রায় সাড়ে ৫ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো ফায়ার সার্ভিস ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মত দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়নি।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই উপজেলায় মোট জনসংখ্যা ছিলো ১,৬৩,১১০ জন। এই ১০ বছরে বেড়ে দু’লক্ষের বেশি হওয়ার সম্ভবনা। অথচ দু’লক্ষ মানুষের জীবনের নেই কোনো নিরাপত্তা।
জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহিনা সুলতানা বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করছি কর্ণফুলীতে আলাদা করোনা ভ্যাকসিনের বুথ স্থাপন করতে কিন্তু সমস্যা হলো ভ্যাকসিন গুলো সংরক্ষণে রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। করোনা ভ্যাকসিন অন্য ভ্যাকসিনের মতো না। এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ রাখতে আলাদা কিছু নিয়ম আছে ও আলাদা তাপমাত্রায় রাখতে হয়। যদিও ভ্যাকসিন কর্ণফুলীতে আনা হয়। ঠিকভাবে যদি সংরক্ষণ করা না যায় তাহলে, ভ্যাকসিন গ্রহণে বিপরীত ফল হতে পারে।’
কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী জানান, ‘মাননীয় ভূমিমন্ত্রী মহোদয় কর্ণফুলীতে ১ দিনের টিকা দেয়ার বুথের ব্যবস্থা করেছেন। কভিড-১৯ টিকা দিতে আগ্রহী যারা নিবন্ধন করেছেন। আর যারা নিবন্ধন করেননি তাঁরা আগামী ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে নিবন্ধন করে নিবন্ধনের কপিসহ ১লা আগষ্ট উপজেলার অস্থায়ী কার্যালয়ে রিভারভিউ কমিউনিটি সেন্টারে (সকাল ৯টা থেকে শুরু) যোগাযোগ করতে পারেন। আগামীতে সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। আশাকর
















