ইউসুফ ইকবাল: শিশির দত্ত চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের পরিকল্পনাকালীন সারথি। উন্মেষকাল থেকেই তিনি এ নগরীর একজন সৃজনশীল সৃষ্টিবিদ, প্রাগ্রসর নাট্যচিন্তক ও স্বতন্ত্র উচ্চতাসম্পন্ন মেধাবী নাট্যজন হিসাবে সুপরিচিত। চট্টগ্রাম নগরীতে সংগঠিত ‘স্পার্ক জেনারেশান’-এর স্পর্ধিত স্পার্ক তিনি- প্রচলের বিরুদ্ধে সচেতন প্রাশ্নিক। তাঁর বিচরণ এবং বিকশিত চিন্তা ও শানিত চেতনার স্ফূরণ শিল্পের দশদিক বিস্তৃত। ষাটের দশক থেকে এ নগরীর নাট্য ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি। সুদীর্ঘ নাট্যভ্রমণকালে সৃষ্টির বহুবর্ণ বিভা তাঁর পরিচয়ে যুক্ত করেছে একাধিক স্বকীয় শোভা।
স্বাধীনতোত্তর নাট্যান্দোলনের উন্মেষকাল থেকেই- স্থানীয়, জাতীয় তথা নিখিল নাট্যপ্রাঙ্গণের উন্নয়নে সম্মিলিত নাট্যপরিকল্পনায় শিশির দত্তের প্রাতিস্বিক ভূমিকা রয়েছে। নাটককে কেন্দ্র করে আবর্তিত তাঁর সৃষ্টি ও অনুশীলন এলাকার পরিসর বহুধা বিস্তৃত। কালের বর্তমান প্রান্তে এসে তাঁর সমূহ কর্মকৃতি রি-সার্চ করে তাঁকে আর নাট্যকলার বিশেষ কোনো একটি পরিচয়ে চিহ্নিত করা যায় না। তিনি সমুজ্জ্বল নাট্যসারথি, বহুভঙ্গিম শিল্পী, পারঙ্গম কর্মী, শিল্পমগ্ন ধ্যানী। তাঁর ধ্যান, কর্ম ও অনুশীলনের কেন্দ্রে রয়েছে বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীলতা। তিনি নাট্যরচনা ও নির্দেশনাসহ শিল্পের বিবিধ দক্ষতায় শিরোধার্য স্রষ্টা। তবে, শিল্পপ্রাঙ্গণে তাঁর স্রষ্টা সত্তা ছাপিয়ে বারবার প্রধান হয়ে উঠেছে তাঁর দ্রষ্টা পরিচয়। চট্টগ্রাম নাট্যাঙ্গনে তিনি উন্মোচন করতে চেয়েছেন দিগন্ত অভিসারী চিন্তা, প্রথাবিরুদ্ধ মত ও পথ। ফলত, ইতি-নেতি, গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্নে তিনি তর্ক-বিতর্কেরও মধ্যমণি।
চট্টগ্রামের নবনাট্যাঙ্গনের প্রস্তুতিপর্বের অন্যতম প্রধান স্থাপত্যিক, চিন্তক ও পরিকল্পক হিসাবে শিশির দত্ত দ্বিধাহীন মান্য-নাট্যজন। নাট্যাঙ্গনে তাঁর কর্মতৎপরতার প্রধান বৈশিষ্ট্য নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যসংগঠক হিসাবে প্রতিফলিত হলেও তা প্রচলিত পরিচয়ের অনুগামী নয়। প্রায়শ তিনি দৃশ্যের অন্তরালে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সৃষ্টির সমন্বিত সংগ্রামে। প্রকাশ্যে নেপথ্যে প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা ও উচ্চতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা অনন্য। এর পরিচয় রয়েছে নাটকের দলীয়, একক ও সম্মিলিত উদ্যোগ আয়োজনের প্রতিপ্রান্তে। একক দলের দীর্ঘতম নাট্যোৎসব, ঢাকার সাথে যৌথপ্রদর্শনী, চট্টগ্রাম থেকে নাটকের প্রথম বিদেশযাত্রা, মঞ্চনাটককে গ্রামে নিয়ে যাওয়া, প্রথম বহুমাধ্যম নাট্যপ্রযোজনা, জ্ঞানতাত্ত্বিক আয়োজন, সেমিনার, প্রকাশনা, তথ্যায়ন- প্রভৃতি তাঁর প্রাতিস্বিক নাট্যভূমিকার চুম্বক উদাহরণ। মননের প্রাগ্রসরতা, উচ্চতর বৌদ্ধিকতা, সূক্ষ্ম চিন্তনদক্ষতা, বক্তব্যের গভীরতা ও বাগ্মীতাগুণ তাঁকে দিয়েছে চারিত্রিক পরিচয়ের সামৃদ্ধিক স্বতন্ত্রতা।
ভিন্নধারার নাট্যনির্মাণ প্রচেষ্টায় চিন্তন, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় শিশির দত্ত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর অনুসন্ধানী মন প্রচলিত নাট্যভাবনার বিপরীতে নাটকের নতুন ক্ষেত্রসমীক্ষায় সংযুক্ত। নাটকের সাথে তৃণমূল মানুষকে একাত্মকরণ, সামাজিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ, নাটকের মাধ্যমে শিক্ষা ও উন্নয়নভাবনার প্রায়োগিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এ-সমীক্ষার আওতাভুক্ত। তিনি উন্নয়ন থিয়েটারের একজন অভিজ্ঞ রিসোর্স। সেই সূত্রে সাম্মানিক সদস্যপদ পেয়েছেন বিদেশের নানা নাট্যসংস্থার। কর্ম, পেশা ও নেশাসূত্রে তিনি বিশ্বনাট্যের অজস্র তীর্থভূমির দর্শন পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক নানা সেমিনার ও নাট্যকর্মশালায় অংশ নিয়ে নিজেকে পরিস্রুত করেছেন। বর্তমান বিশ্বের অনেক স্বনামধন্য নাট্যবিদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর হাত ধরে চট্টগ্রাম নাট্যাঙ্গনে এসেছেন অনেক নাট্যবিদ। তাদের সাথে আড্ডা, আলাপ, সেমিনারে তুলে ধরেছেন নিজস্ব নাট্যবিশ্বাস। এভাবে তিনি নিজের বিশ্বাস, কর্ম-অভিজ্ঞতা ও অন্যের নাট্যচিন্তার মিথস্ক্রিয়ায় নিজেকে ও সতীর্থদের সমৃদ্ধ করেছেন। সে সব চিন্তার প্রকাশ রয়েছে তাঁর প্রবন্ধে-নিবন্ধে- দেশে বিদেশে নানা জার্নালে। তাছাড়া, বিশ্বথিয়েটারের অনেক নাটক, নাট্যকার, থিউরিস্ট, ড্রামাটার্গ: নানা টার্মস ও টারমিনলজির পরিচয় তুলে ধরেছেন গ্রন্থাকারে।
উন্মেষকালের মঞ্চহীন, কর্মীহীন, দর্শকহীন চট্টগ্রামের প্রতিকূল নাট্যাঙ্গনে শিশির দত্ত ছিলেন বৈরীস্রোতে অন্যতম নির্ভরতা। সেই বন্ধুর নাট্যপ্রাঙ্গণের উৎকর্ষসাধনে তিনি উৎসর্গ করেছেন জীবনের অর্ধশতক বছর। চট্টগ্রাম নাট্যাঙ্গনের এই প্রণম্য প্রবীণের একজীবনের সমূদয় নাট্যকর্মকীর্তি আজও জাতীয়দৃষ্টির অগোচরে থেকে গেল। আমাদের দৃষ্টি আরও স্বচ্ছ, প্রসারিত ও নিরপেক্ষ হলে অনেক আগেই তিনি স্বীকৃতির জাতীয় তালিকায় যুক্ত হয়ে যেতেন। শিশির দত্তের জাতীয় পুরস্কার না পাওয়াটা জাতীয় উপেক্ষা ও অবহেলারই নামান্তর। ঢাকার বাইরের এরকম অনেক প্রণম্য নাট্যজন জাতীয়দৃষ্টিবঞ্চিত অবহেলার শিকার। এটা জাতির গ্লানিকেই কেবল দীর্ঘায়িত করে।