অবশেষে করোনায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’সহ অনেক কালজয়ী গানের গীতিকার ফজল–এ–খোদা। গত বৃহস্পতিবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তিনি।
আজ ৪ জুলাই, রোববার ভোর চারটায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। গণমাধ্যমকে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তাঁর ভাতিজি অরিনা বরকত-এ-খোদা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।তিনি স্ত্রী, তিন পুত্রসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফজল–এ–খোদা সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গতকাল তাঁকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তাঁর স্ত্রী মাহমুদা সুলতানা মঞ্জু এখনো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
অরিনা বরকত-এ-খোদা জানান, আজ সকাল ১০টায় ঢাকার রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ফজল-এ-খোদার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তিনি জানান, তাঁর চাচির শারীরিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না।
বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক এই গুণী মানুষটির জন্ম ১৯৪১ সালের ৯ মার্চ, পাবনার বেড়া থানার বনগ্রামে। বাবা মুহাম্মদ খোদা বক্স এবং মা মোসাম্মাত জয়নবুন্নেছার তিনি প্রথম সন্তান।
বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে ১৯৬৩ সাল থেকে ফজল-এ-খোদার কর্মজীবন শুরু। পরের বছর বাংলাদেশ টেলিভিশনেও তালিকাভুক্ত হন। তাঁর লেখা অনেক শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর লেখা অনেক গানের মধ্যে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ মুক্তিযুদ্ধে বহু মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। ১৯৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তাঁর লেখা গণসংগীত ‘সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে, দিন রাত অবিরাম’ গানটি তৎকালীন টেলিভিশন প্রচার করে।
ফজল-এ-খোদার কালজয়ী অনেক গান এখনো মানুষকে আন্দোলিত করে। ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’, ‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, বাসন্তী রং শাড়ি পরে কোন রমণী চলে যায়’, আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’, ‘প্রেমের এক নাম জীবন’, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো, পথের ধুলোয় লুটোবে’, ‘বউ কথা কও পাখির ডাকে ঘুম ভাঙরে’, ‘খোকনমণি রাগ করে না’ ইত্যাদি। ফজল-এ-খোদার গানগুলো বশীর আহমেদ, আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের কণ্ঠের মাধ্যমে দর্শক–শ্রোতার কাছে পৌঁছেছে। আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, কমল দাশগুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টাচার্য, সত্য সাহা প্রমুখ গুনী সংগীতজ্ঞ ফজল-এ-খোদার গানে সুরারোপ করেছেন।
ছড়া দিয়ে তাঁর লেখালেখির শুরু। তাঁর ছড়া গ্রন্থের সংখ্যা ১০ আর কবিতা গ্রন্থ ৫টি। গান, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য নিয়ে তাঁর মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৩। এ ছাড়া সত্তর দশকে শিশু–কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘শাপলা শালুক’ তার সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হতো। শিশু-কিশোর সংগঠন শাপলা শালুক আসরেরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা। সদস্যদের কাছে ফজল-এ-খোদা ‘মিতা ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হলে ফজল-এ-খোদা তাঁর দুঃখ এবং ক্ষোভ গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। বশীর আহমেদের সুরে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া ফজল-এ-খোদার সেই গানটি ছিল ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো/ পথের ধুলোয় লুটোবে/ সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন-বিহঙ্গ/ সহসা পাখনা লুটোবে/ এমন তো কথা ছিল না’। ১৯৭৬ সালে গানটি রেকর্ড ও বেতারে প্রচারিত হয়। ফজল-এ-খোদার লেখা এবং মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুরারোপ করা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ২০০৬ সালে বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের সেরা ২০ গানের তালিকায় ১২তম স্থান পায়। ১৯৬০–এর দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর ফজল-এ-খোদা দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোকসংগীত, ইসলামি গান লিখেছেন।
এদিকে ফজল-এ-খোদার মৃত্যুসংবাদ তাঁর জন্মস্থান পাবনার বেড়া উপজেলায় পৌঁছার পর সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বেড়ার সর্বসাধারণের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। বেড়া সাংস্কৃতিক সংসদের (বেসাস) সভাপতি আল মাহমুদ সরকার বলেন, ‘ফজল-এ-খোদা আমাদের গর্ব ছিলেন। বেড়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর অসামান্য অবদান আমরা কখনোই ভুলতে পারব না।’