চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ব্যয়ের আলোকায়ন প্রকল্পের চুক্তি সই সম্পন্ন হয়েছে শনিবার (৬ জুলাই)। সিটির হোটেল রেডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউতে ‘মডার্নাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পের চুক্তি হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সড়কবাতির আলোয় সিটিকে আলোকিত করা হবে। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র সড়ককে আলোকিত করতে চট্টগ্রামে এত বড় প্রকল্প আগে কখনো নেয়া হয়নি।
গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রাফিক ও পথচারীদের জন্য কার্যকর ও টেকসই সড়ক বাতির আলোক সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। রাত্রিকালীন শহরের সৌন্দর্য, ব্যবসায়িক সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে কমবে কার্বন নির্গমন। এছাড়া, শক্তি শোষণ সম্পর্কিত পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ট্রাফিক ও পথচারীর জন্য রাস্তায় আলোর সুবিধা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি, স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে সড়ক বাতির আলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
২০১৯ সালের ৯ জুলাই একনেক সভায় এ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। চট্টগ্রাম সিটির ৪১ ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়কজুড়ে এলইডি লাইট লাগানোর এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত সরকার ঋণ দিচ্ছে ২১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা এবং সরকারি তহবিল (জিওবি) থেকে দেয়া হচ্ছে ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ পাঁছ হাজার টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়িত হলে সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিল কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। এছাড়াও, বাতিগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫০০টি সুইচের বদলে চারটি কেন্দ্রীয় সার্ভার স্টেশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তাতেও প্রায় ১২ লাখ টাকারও বেশি সাশ্রয় হবে বলে। এ লক্ষ্যে এরমধ্যে দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডের মিয়াখান সওদাগর পোল থেকে ইসহাক সওদাগর পোল পর্যন্ত সড়কের একপাশে এলইডি লাইট স্থাপনের জন্য খুঁটি বসানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে চসিক।
জ্বালানি দক্ষতা উন্নয়নে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের ‘টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ ও ভারতের ‘এনার্জি ইফিসিয়েন্সি সার্ভিস লিমিটেডের (ইইসিএল) সাথে ২০১৭ সালে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। এর প্রেক্ষিতেই প্রকল্পটি নেয় চসিক। প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে এলওসি-৩ (লাইন অব ক্রেডিট)’-এর আওতায় ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ অর্থের যোগান দিবে ভারত। ঋণ হিসেবে দেয়া এ অর্থের পরিমাণ ২১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ পাঁছ হাজার টাকা দিবে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের এক্সিম ব্যাংক তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শর্ট লিস্ট পাঠায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ‘এনার্জি ইফিসিয়েন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড’, ‘সিগনিফাই ইনোভেশন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’ ও ‘শাপর্জি পালনজি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’। শর্ট লিস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোয় দরপত্রে অংশ নেয়। বাছাই শেষে ‘শাপার্জি পালনজি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডকে চূড়ান্ত করা হয়। ২০২৬ সালের ৩০ জন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। চলতি অর্থ বছরে প্রকল্পের আওতায় প্রতি ওয়ার্ডে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার করে ২০৫ কিলোমিটার সড়কে আলোকায়নের কাজ সম্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, চসিকের আওতাধীন সিটির ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে পাঁছ ফুটের বেশি প্রশস্ততার দশ কিলোমিটার সড়ক এলইডি বাতির আওতায় আসবে। বিদ্যুৎসাশয়ী এ বাতি পাঁচ বছর পর্যন্ত জিরো রক্ষাণাবেক্ষণ খরচে চলবে। ওয়ার্ডগুলোতে ৪০, ৬০, ১০০ ও ২৫০ ওয়াটের মোট ২০ হাজার ৬০০টি এলইডি বাতি, ২০ হাজার ২৬৭টি জিআই পোল ও ৫০৭টি কন্ট্রোল সুইচ বক্স বসানো হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুৎ বিল কমে যাওয়াসহ বাতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয়ভাবে চারটি সার্ভার স্টেশন স্থাপন করা হবে। এছাড়া হাইড্রোলিক বিম লিফটার ও ইলেকট্রিক্যাল ইক্যুপমেন্ট সংগ্রহ করা হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে ভারত। ভারতের সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসী আলোকিত চট্টগ্রাম পাবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে সহায়ক হবে এ প্রকল্প।’
সভাপতির বক্তৃতায় চসিকের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৬০ কিলোমিটার সড়কের আলোকায়ন হতে যাচ্ছে; যা পরিবেশ বান্ধব, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী, টেকসই ও কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এটি বাস্তবায়নের পর চট্টগ্রামের কোন অলি-গলি আলোকায়নের বাইরে থাকবে না। কারণ, আমরা বড় রাস্তায় বর্তমানে বিদ্যমান বাতিগুলো দিয়ে সিটির অলি-গলির আলোকায়ন সহজে করে ফেলতে পারব। ফলে, নগরবাসীর নিরাপত্তা ও স্বস্তি বাড়বে এবং নগরের ল্যান্ডস্কেপে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। আমি মেয়র হিসেবে কথা দিচ্ছি, এ প্রকল্প যাতে সঠিকভাবে ও যথাযথ গুণগত মান রক্ষা করে বাস্তবায়িত হয়, সে ব্যাপারে আমার কঠোর তদারকি নিশ্চিত করব।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই-কমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে ছিল ভারত। বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকার টোকেন অফ ফ্রেন্ডশীপ হিসেবে কাজ করবে এ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধবভাবে চট্টগ্রামকে আলোাকিত করা সম্ভব হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান প্রকল্পের সফলতা কামনা করেন।
অনুষ্ঠানে সাংসদ আবদুচ ছালাম, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম, ডিআইজি নূরে আলম মিনা, ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার রাজীব রঞ্জন, চট্টগ্রওাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ ছিলেন।
অনুষ্ঠানে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন, প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ উপস্থিত ছিলেন।