ঢাকা: জনগণের সেবা করাকে একটি বড় কাজ হিসেবে উল্লেখ করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকে জনগণের সেবা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এটি তাদের ভবিষ্যত ভোট নিশ্চিত করবে। আপনারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। জনগণের সেবা যদি আপনারা নিশ্চিত করতে পারেন, ভবিষ্যতে আপনাদের ভোটের কোন চিন্তা থাকবে না। মানুষই আপনাদের ওপর আস্থা রাখবে, বিশ্বাস রাখবে।’
বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) সকালে তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে দুই সিটি করপোরেশন কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের নতুন নির্বাচিত মেয়র এবং পাঁচ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে তিনি এসব এ কথা বলেন।
স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের জনকল্যাণে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস কোনভাবেই হারাবেন না। তাই, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেই অনুযায়ী মানুষের জন্য কাজ করুন।’
তার সরকার দেশের প্রতিটি এলাকার উন্নয়ন করেছে ও তৃণমূলের মানুষকে ঘিরেই এ উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জনপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে কাজ করার ও বর্তমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার আহবান জানান।
সরকার প্রধান বলেন, ‘এরমধ্যে দেশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। যেটা আপনারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছেন। এ পরিবর্তন ধরে রেখে আরো উন্নতি করতে জনগণের কাছে দেয়া ওয়াদা আপনাদের রক্ষা করতে হবে।’
জনগণকে উন্নত সেবা প্রদান, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও পরিকল্পিত সিটি গড়ে তোলা তার সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরমধ্যে আমরা ঘোষণা দিয়েছি, ‘আমার গ্রাম, ‘আমার শহর।’ অর্থাৎ গ্রামের মানুষ সব নাগরিক সুবিধা পাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ প্রেক্ষাপটে আমি আপনাদেরকে আন্তরিকতার সঙ্গে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর, তাদের সেবা করার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’
দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিদের সজাগ থাকার নির্দেশনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের পথ থেকে সবাই যেন দূরে থাকে, সেদিকে আপনাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রথম নারী মেয়র তাহসিন বাহার সুচনা এবং ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র একরামুল হক টিটুকে শপথ বাক্য পড়ান। একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের নতুন নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের শপথবাক্য পড়ান। পাঁচটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা হলেন কুড়িগ্রামের এএনএম ওবায়দুর রহমান, ঠাকুরগাঁওয়ের আবদুল মজিদ, সিরাজগঞ্জের শামীম তালুকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিল্লাল মিয়া ও হবিগঞ্জের আলেয়া আক্তার। পরে, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সাধারণ ওয়ার্ডের নতুন নির্বাচিত ৪৪ জন কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলররাও একই স্থানে শপথ নেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম কাউন্সিলরদের শপথ বাক্য পড়ান। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইব্রাহিম।
গেল ৯ মার্চ সিটি করপোরেশনের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন কুমিল্লা-ছয় আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসিন বাহার সুচনা। তিনিই কুমিল্লার প্রথম নির্বাচিত নারী মেয়র হলেন। একই দিনে অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন একরামুল হক টিটু।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে। সবার পূর্বে যেটা দরকার, তা হচ্ছে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়া। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। একমাত্র আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে, তখনই এ দেশের মানুষ অন্তত পক্ষে এইটুকু পেয়েছে- সরকার জনগণের শোষক নয়, সেবক হিসেবেই কাজ করে। যার কারণে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গেল ১৫ বছরে আমি অন্তত এইটুকু দাবি করতে পারি, বাংলাদেশ এখন বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। যার বয়স ১৫ বছর, সে হয়তো ভাবতেও পারবে না যে, ১৫ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০০৯ সালের পূর্বের বাংলাদেশ কী অবস্থায় ছিল? বাংলাদেশে সেখান থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করেছি। সবচেয়ে বড় কথা দারিদ্র্যের হার আমরা পেয়েছিলাম ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ। সেখান থেকে কমিয়ে আমরা ১৮ দশমিক সাত শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল যে, অন্তত আমরা ১৬ বা ১৭ শতাংশের নামিয়ে আনব। যেটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান। আমরা তা-ও করতে পারতাম, যদি করোনা ভাইরাস মহামারি না দেখা দিত। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি না হত, নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে প্রত্যেকটা খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। ভোজ্য তেলের মূল্য বেড়ে গেছে, জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে, গ্যাসের মূল্য বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে। এগুলো যদি না হত, আমরা কিন্তু আরো দ্রুত এগিয়ে যেতে পারতাম। আমাদের দারিদ্র্যের হার আরো কমাতে পারতাম।’
অতি দরিদ্র প্রায় ২৫ ভাগের ওপরে ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেটা আমরা পাঁচ দশমিক ছয় ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এত দ্রুত অতি দরিদ্রের হার কমানো, আমার মনে হয়, পৃথিবীর অন্য কোন দেশ এটা পারেনি। আমরা লক্ষ্য স্থির করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে কেউ আর ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না, অতি দরিদ্র বলে কেউ থাকবে না।’
কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তার সরকার স্বাস্থ্য সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখান থেকে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে।’
কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে জনগণ যাতে সঠিকভাবে স্বাস্থ্য সেবা পেতে পারে, সেদিকে তিনি জনপ্রতিনিধিদের লক্ষ্য রাখতে বলেন। পাশাপাশি, তিনি বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার এবং প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে খাদ্যোৎপাদন বাড়াতে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখার জন্যও জনপ্রতিপ্রতিনিধিদের প্রতি আহবান জানান।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় সতর্কতার অংশ হিসেবে তিনি দেশের নদী-নালা, খাল, বিলসহ বিভিন্ন জলাশয় সংরক্ষণ করা এবং পানির প্রবাহকে অব্যাহত রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেন।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, তার সরকার স্থানীয় সরকার খাতে বাজেট বরাদ্দ আট গুণের বেশি বাড়িয়েছে। কারণ, বিএনপির শাসনামলে ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল মাত্র পাঁচ হাজার ৭৯৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা বর্তমানে ৪৬ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘প্রতিটি এলাকায় উন্নয়ন হয়েছে ও যোগাযোগ ব্যবস্থারও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।’
‘কাজেই, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ও কাজের মান বজায় রাখার জন্য আপনাদের কাজ করা উচিত।’ বলেন তিনি।