অলোক ঘোষ পিন্টু – চট্টগ্রামের নাট্যজগতের এক নিবেদিতপ্রাণ নির্দেশক, সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই অনেক নাট্যপ্রেমীর মনে ভেসে ওঠে অনুশীলনভিত্তিক মঞ্চনাটকের দৃশ্য, চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য এবং দীর্ঘ দিনের নিরবিচ্ছিন্ন নাট্যভ্রমণ। তিনি শুধু নির্দেশকই নন, একজন নাট্যদর্শনের অনুসন্ধানী চিন্তক, যিনি দর্শকের মানসিক গহ্বরে প্রবেশ করতে জানেন। তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, তা কেবল প্রশংসায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না- চলবে না কারণ তিনি একজন ‘নির্দেশক’, কিন্তু সেই নির্দেশনায় তিনি কতটা নড়াচড়া আনতে পেরেছেন, সেটাই প্রশ্ন।
অলোক ঘোষ পিন্টু: ‘নাট্যনির্দেশক’ না ‘অভ্যস্ত অভ্যাসিক’?
পিন্টু দার কাজ দেখলে প্রথমেই একধরনের সজ্জা-নির্ভরতা চোখে পড়ে। সবকিছু গুছিয়ে উপস্থাপন করার এক ধরনের ‘ধর্মীয় নিষ্ঠা’ তাঁর মধ্যে আছে, কিন্তু এই নিষ্ঠার ভেতরে কি যথেষ্ট শিল্পগভীরতা আছে? অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর নির্দেশিত নাটকগুলোতে আমরা দেখি- চরিত্রগুলো নিপাট; তারা চমকে দেয় না, সংলাপে গভীরতা কম, নাটকীয় টেনশন ক্রমে ভেসে যায়, অভিনয়ের তীব্রতা মাঝে মাঝে কাঠামোগত তদারকির ভেতরেই আটকে থাকে।
তিনি যেন এমন এক শিল্পী, যিনি প্রতিটি নাটককে সাজান পরিপাটি করে, কিন্তু কখনও সেই নাটকে আগুন লাগান না। তাঁর নির্দেশনায় যেন নান্দনিকতার একটি নিখুঁত চিত্রকলার মত আবেশ আছে- কিন্তু যেখানে রং আছে, ব্যথা নেই; শব্দ আছে, স্তব্ধতা নেই; বর্ণনা আছে, রক্ত নেই।
নির্দেশনায় সৌন্দর্যবোধ, কিন্তু কোথায় তীক্ষ্ণতা?
পিন্টু দার নির্দেশনার প্রধান বৈশিষ্ট্য – পরিপাটি নির্মাণ। কিন্তু সে নির্মাণে বিপ্লব নেই, প্রতিবাদ নেই, রাজনৈতিক উত্তাপ নেই। সামাজিক প্রেক্ষাপটের নাটক বানালেও তাঁর কাজ যেন প্রায়শই ‘শালীন অসন্তোষে’ আটকে থাকে। তিনি বাস্তবতা তুলে ধরেন, কিন্তু বাস্তবতাকে বদলানোর হাহাকার নেই। নাটকটা ‘মেসেজ’ দিয়েই শেষ হয়ে যায় – বোধ বা অনুরণন তৈরি করে না। যেন পোস্টার, না কোনো রক্তমাখা খোলা মঞ্চ।
পিন্টু দার থিয়েটার অনেকটা আয়নার মতো- যেখানে দর্শক নিজের প্রতিবিম্ব দেখে, কিন্তু আয়নার কাচ ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহস পায় না। তাঁর নির্দেশনায় নাটক একটি নিরাপদ অভিজ্ঞতা – যেখানে দর্শক ঘাম ঝরায় না, অস্থির হয় না, কেবল দেখে যায় এক নির্ভুল পরিবেশনা।
শিল্পী গড়ার চেয়ে নাম গড়ার রাজনীতি:
পিন্টু দার চারপাশে যে ‘নাট্যকুটির’ গড়ে উঠেছে, তা একদিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ শিক্ষার জগৎ, আবার অন্যদিকে একধরনের নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির বলয়। তিনি নতুনদের শেখান নিঃসন্দেহে, কিন্তু শেখানো যেন এক নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা – শিল্পী নয়, তৈরি হয় নির্দেশকের কণ্ঠনির্ভর চরিত্র। তাঁর হাতে গড়া শিল্পীরা কখনো কখনো এতটাই নিয়মতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, যে সেই অভিনয়ে মায়া থাকে না-থাকে মেকানিক্যাল কায়দা। এখানেই পিন্টু দা যেন নিজেরই ছায়ায় আটকে পড়েছেন – তিনি থিয়েটারকে নিয়ন্ত্রণ করেন, কিন্তু থিয়েটার তাঁর হাত ফসকে আর কোথাও উড়তে পারে না।
সংগঠক হিসেবে সফল, শিল্পী হিসেবে সীমিত:
চট্টগ্রামের থিয়েটার দৃশ্যপট বরাবরই নানা সমস্যায় জর্জরিত – সরকারি অনুদানের অভাব, জায়গা সংকট, টেকনিক্যাল ব্যবস্থার দুর্বলতা। এই প্রতিকূলতায়ও অলোক ঘোষ পিন্টু থেমে থাকেননি। নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন নাট্যোৎসবের আয়োজন, নিজস্ব অর্থায়নে নাটক মঞ্চায়ন। কিন্তু তাঁর কাজের মূল সংকট হলো – তিনি নাট্যভাষায় নতুন কিছু যোগ করেননি। তাঁর থিয়েটার একটি প্রতিষ্ঠিত ফর্ম, যেটা দর্শকের আরাম দেয়, কিন্তু অস্থির করে না। থিয়েটার যখন শুধুই সংবেদনহীন আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যায়, তখন তা আর শিল্প থাকে না। পিন্টু দার কিছু কাজ সে দিকেই পা বাড়ায়- যেখানে দর্শক দেখেন, মুগ্ধ হন, কিন্তু চেতন হন না।
নাট্যপাঠ নয়, নাট্যসংলাপের সংকট:
তাঁর নির্দেশনায় নাট্যগ্রন্থের গভীর পাঠের অভাব, থিয়েটার ইতিহাস বা দার্শনিক ধারার কোনো রেফারেন্স নেই। পিন্টুর থিয়েটার ‘নতুন কিছু বলছে’ না, বরং পুরনো কিছু সুন্দরভাবে বলছে। তিনি নাট্যনির্দেশক নন, নাট্যসাজসজ্জাকার। যিনি জানেন কীভাবে নাটক উপস্থাপন করতে হয়, কিন্তু জানেন না নাটক কেন করতে হয়। পিন্টু দার থিয়েটার কখনো কখনো এক ধরণের অলঙ্কারে মুড়ে দেওয়া নাট্যদেহ – যেখানে দেহ আছে, কিন্তু আত্মা অনুপস্থিত।
তাঁর নির্দেশিত কিছু নাটকের বিশ্লেষণ:
‘রক্তাক্ত প্রস্তাব’ – এক রক্তহীন বিপ্লব:
নাটকে রাজনৈতিক উত্তাপ নেই, বরং আছে ‘বুদ্ধিদীপ্ত রিহার্সাল’। সংলাপে আবেগ আছে, কিন্তু মুখভঙ্গিমায় নেই। চরিত্রের আন্দোলন যেন প্রস্তুতিপর্বেই আটকে যায়। নাটকটি যেন পাঠ্যপুস্তক পড়ে শোনানোর মতো – চোখে পড়ে, মনে থাকে না।
‘অন্তরালের আলো’ – অন্তরালের বাইরে আলো পড়ে না:
নারীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা থাকলেও তা পুরুষ নির্দেশকের চোখ দিয়েই দেখা। সংলাপে আবেগ থাকলেও শরীরে তা অনুপস্থিত। নাটক শেষে হাততালি হয়, চোখে পানি জমে না। এটি একটি ভালো অভিপ্রায় – দূর থেকে আঁকা এক নারীমূর্তি, যে নিজে কথা বলে না।
‘নির্বাক শূন্যতা’ – ভাষাহীন উচ্চারণে থিয়েটারের মৃত্যু:
বিমূর্ত, নন্দনতত্ত্ব নির্ভর, কিন্তু দর্শক বিচ্ছিন্ন। থিয়েটার যদি শুধুই ফর্ম হয়, তবে দর্শক হারায়। এই নাটকটি দারুণ একটি পরিকল্পনা, কিন্তু একটি ব্যর্থ প্রেমের মতো – যেখানে সৌন্দর্য আছে, কিন্তু সম্পর্ক নেই।
‘একটি রাষ্ট্র ও একটি জনতা’ – রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়, রাষ্ট্রচিন্তার সেমিনার:
শিরোনাম বিপ্লবের ডাক দেয়, কিন্তু নাটকটি বক্তৃতার মতো। চরিত্রেরা প্রতিনিধি মাত্র, তারা মানুষ নয়। নাটকটি থিয়েটার নয়, সভাকক্ষের ভাষণ। রাষ্ট্রকে প্রশ্ন না করে, রাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা করা হয়।
‘বিষণ্ন লোকটির গল্প’ – বিষাদ আছে, ছায়া পড়ে না:
মনস্তাত্ত্বিক নাট্যচরিত্র, যেখানে বিষাদ নিখুঁতভাবে সাজানো, কিন্তু হৃদয় স্পর্শ করে না। নাটকটি আবেগ তৈরি করতে গিয়ে একঘেয়ে হয়ে পড়ে। বিষণ্নতা এখানে এক নান্দনিক সাজ, অভিজ্ঞতা নয়।
অলোক ঘোষ পিন্টুর নির্দেশনায় নাটক হয় – নাট্যশিল্প হয় না:
তাঁর নির্দেশনায় সুশৃঙ্খলতা আছে, কিন্তু সৃজনশীলতা নেই। তিনি থিয়েটারকে আগলে রেখেছেন, কিন্তু থিয়েটারকে সামনে নিয়ে যাননি। তিনি এখনও আগুন নন – একটি গনগনে কয়লা, যার আলো রয়েছে, কিন্তু দহন নেই। পিন্টু দা, আপনি মঞ্চকে ভালোবেসেছেন, এবার মঞ্চের দিক থেকে প্রশ্ন – আপনি কি এখনও থিয়েটারকে ভালোবাসেন, নাকি শুধু থিয়েটারের ধারণাটাকেই আগলে রেখেছেন? তাঁর কাজগুলো হয়তো সংগঠনের ইতিহাসে জায়গা করে নেবে, কিন্তু শিল্পের ইতিহাসে জায়গা পেতে হলে তাঁকে আবার ফিরে আসতে হবে – একটি নতুন শূন্যতা নিয়ে, যেখান থেকে শুরু হতে পারে এক নতুন চিৎকার।