নাট্যজগত একটি নীরব নদীর মতো- যার স্রোত থাকে গভীরে, মুখরতা থাকে আলো-ছায়ার ভেতরে। এই নদীরই অন্তর্গত স্রোতের এক তীব্র অথচ পরিশীলিত মুখ হলো সনজীব বড়ুয়া। তিনি চট্টগ্রামের মঞ্চনাট্যের এমন এক নাম, যাঁর কণ্ঠ, চরিত্র নির্মাণ, সংলাপ, ও উপস্থিতি- সবকিছু মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক নিবেদিত নাট্যজীবন।
তাঁর নাট্যপথ ৫ দশকের অধিক দীর্ঘ। অভিনয়, নির্দেশনা, নাট্যরচনা, সংগঠন- প্রতিটি পর্বেই তিনি যুক্ত ছিলেন একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর যে অবদান, তা নিছক মঞ্চস্থ নাটকের তালিকা নয়- তা ইতিহাসের ছায়াচিত্র।
সনজীব বড়ুয়ার গ্রুপ থিয়েটার চর্চার শুরু গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। গণায়নের প্রথম প্রদর্শনীর অভিনেতা ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারিতে মিলন চৌধুরী, শান্তনু বিশ্বাস এবং উনার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট। তিনি অভিনয়কে দেখেছেন আত্মসাধনার পথ হিসেবে। নাট্যচরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করে, নিজের সঙ্গে তার মোলাকাত ঘটিয়ে, চরিত্রকে বাঁচিয়ে তোলাই তাঁর শিল্পসাধনা। তাঁর অভিনয়ে নেই কোনও অতি নাটকীয়তা; বরং সংযত অথচ গভীর এক বাচিক মেধা, আবেগ ও সংলাপ প্রক্ষেপণের নির্মোহ ভঙ্গি। দর্শক তাঁর অভিনয় দেখলে শুধু চরিত্র দেখতে পায় না, দেখতে পায় এক সজীব মানবচিত্র।
সময়ের রেখায় এক শিল্পীর পথচলা:
সত্তর দশকের শুরুতে যখন স্বাধীন বাংলাদেশ নানা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই নাট্যচর্চা পেয়েছিল এক নবজাগরণ। চট্টগ্রামে সেই উন্মেষ-পর্বে সনজীব বড়ুয়া তাঁর পদচিহ্ন রাখেন। তাঁকে দেখা যায় প্রথম দিকে ছোট নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে অভিনয় শুরু করতে। তাঁর প্রথম দিকের কাজগুলো ছিল রীতিমতো পরীক্ষামূলক—যেখানে তিনি চর্চা করেছেন সামাজিক নাটক, ঐতিহাসিক নাটক, বুদ্ধিবৃত্তিক নাট্যভাবনার নানা ভঙ্গি। আশির দশকে তাঁর অবস্থান হয়ে ওঠে দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত। এই সময়ে তাঁর অভিনীত ও নির্দেশিত নাটকগুলো পেয়েছে প্রশংসা ও স্বীকৃতি। নাট্যপ্রেমীরা মঞ্চে খুঁজতে থাকেন তাঁর উপস্থিতি। নব্বইয়ের দশকে এসে তিনি হয়ে ওঠেন নাট্যজীবনের অন্যতম মুখপাত্র। এই সময়ে তাঁর নাট্যরচনা ও নির্দেশনা বিস্তৃত হয়। বর্তমানে তিনি একধরনের স্থিত ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন পর্বে অবস্থান করছেন। এখন তাঁর কাজ কম হলেও- তাঁর প্রভাব, অভিভাবকসুলভ উপস্থিতি নাট্যজীবনের অনেক তরুণ কর্মীকে উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। নাট্যবীক্ষার এমন এক ব্যক্তিত্ব এখনো তরতাজা, দৃঢ়চিন্তায় প্রতিফলিত।
অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ:
মহেশ – চরিত্রের বেদনাকে এতটুকু উচ্চারণে কীভাবে তুলে ধরা যায়, তা তিনি দেখিয়েছেন এই নাটকে। আভ্যন্তরীণ খেলাধুলা – রাষ্ট্র ও পরিবারের দ্বন্দ্বে মানুষের ভেতরের খেলা কেমন হয়, সে চিত্র তিনি দৃঢ়ভাবে রূপায়ণ করেছেন।
নিবারণের স্বপ্ন স্বদেশ – ইতিহাস ও স্বপ্ন একাকার হয়ে উঠেছে তাঁর অভিনয়ে।
গোধূলির আলো – বয়স ও সময়ের ক্লান্তি যেন তাঁর চোখ ও ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছে।
শেষ বিকেলের গল্প – অবসরের বিষাদে ভরা মানুষটিকে তিনি নির্মাণ করেছেন ভাষাহীন অভিব্যক্তিতে।
বদলি -শ্রেণিসংগ্রাম, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তাঁর কণ্ঠে যেন প্রতিবাদের গর্জন হয়ে উঠেছে।
রচিত নাটক:
বাজলো রাজার বারোটা – সমকালীন সংকট, রাজনৈতিক ব্যর্থতা, বুদ্ধিজীবী সমাজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব- সবকিছু মিলিয়ে এই নাটক এক সময়বক্তব্য। এ নাটকে দর্শক যেমন হাসে, তেমনি ভাবে, কাঁদেও।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
জিয়া হায়দার নাট্যপদক (২০১৪) – চট্টগ্রামের মঞ্চনাট্যে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘নাট্যাধার’ ও ‘জিয়া হায়দার ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক এই পদকে ভূষিত হন। তাঁর ৫০ বছরের নাট্যযাত্রা এ সম্মাননায় নতুন আলোকপাতে উদ্ভাসিত হয়।
নির্দেশনায় সুনিপুণ হাত:
সনজীব বড়ুয়া একজন চিন্তাশীল নির্দেশকও। তাঁর নির্দেশনায় যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে, তাতে আমরা দেখি সহজ উপস্থাপনাশৈলী, দৃঢ় বয়ান, এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে এক গভীর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। তিনি নাটকের মধ্যে দৃশ্যের চেয়ে অন্তর্দৃশ্যকে বেশি গুরুত্ব দেন। চরিত্রকে তিনি বাঁচিয়ে তোলেন না শুধু অভিনয়ে, বরং নির্দেশনার মধ্য দিয়ে তাঁর মানসপ্রক্রিয়াও তুলে ধরেন।
নাট্যভাবনা ও সমাজ:
তাঁর নাট্যদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব। তিনি মনে করেন নাটক শুধুই মঞ্চস্থ বিনোদন নয়, তা সমাজের প্রতিফলন, তা প্রশ্ন তোলে, আলোচনার জন্ম দেয়, চিন্তা সঞ্চার করে।
তাঁর নাটকে উঠে আসে- মূল্যবোধের অবক্ষয়, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক, নিঃসঙ্গতা, পরাজয় ও আত্মপ্রত্যয়ের ভাঙাগড়া। এসব বিষয়কে তিনি সরাসরি না বলে, নাট্যরূপের আড়ালে পরোক্ষভাবে তুলে ধরেন, যা দর্শকের মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখে।
ব্যক্তিত্ব ও উত্তরাধিকার:
ব্যক্তিজীবনে সনজীব বড়ুয়া একজন সজ্জন, শান্ত ও চিন্তাশীল মানুষ। তরুণদের সঙ্গে মিশে যান সহজেই। তাঁর মতো শিল্পী খুব বেশি নেই, যিনি নিরবিচারে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিলিয়ে দিতে ভালোবাসেন। তাঁর নাট্যচিন্তা এবং শিল্পজীবন এখনো অনেক তরুণ কর্মীর পথনির্দেশ। তাঁর উপস্থিতি নাট্যআঙিনায় শুধু একজন শিল্পী নয়, একজন পথপ্রদর্শক হিসেবেই অনুভূত হয়। তিনি নাট্যভাষা ও সমাজ-ভাষার সংযোগস্থল। তিনি মঞ্চের আলো আর কণ্ঠের মধ্য দিয়ে এক নতুন বোধ নির্মাণ করেন।
সনজীব বড়ুয়া- এই নামটি আজ চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার এক অনিবার্য প্রতীক। তাঁর কাজে যেমন আছে আত্মনিবেদন, তেমনি আছে ভাষাগত শুদ্ধতা, চরিত্র নির্মাণে নিষ্ঠা ও নাট্যশৈলীর প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা। তাঁর রচনাবলি, নির্দেশনা ও অভিনয় আজও তরুণ প্রজন্মের কাছে আলোকবর্তিকা। তিনি শুধুই একজন অভিনেতা নন, একজন শিল্পযোদ্ধা। যাঁর প্রতিটি অভিনয়, নির্দেশনা ও রচনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—নাটক শুধু বিনোদন নয়, তা এক গভীর মানবিক অন্বেষণ।