হাটহাজারী, চট্টগ্রাম: ‘কলমের আঁচড়ে প্রগতির পাঠ’- এ স্লোগানকে ধারণ করে তেপান্তর সাহিত্য সভা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আয়োজনে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: পুলিশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার অনষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুরে চবির সমাজবিজ্ঞান অনুষদ কনফারেন্স হলে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন চবির উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান এবং প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন চবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন।
তেপান্তর সাহিত্য সভা চবির সভাপতি মো. আব্দুল মোমিনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও চবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী এবং বিশেষ আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন চবির ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চবির আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদ।
সেমিনরে মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকার বিগত সাড়ে ১৫ বছর দেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার এবং নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা দেশে গুম, খুন, অন্যায়, অবিচারসহ সকল ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। গত জুলাই গণআন্দোলনে দেশের ছাত্র-জনতা এ ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলে, অত্যাচারিত সরকারকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হতে হয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে একটি টেকসই (সাসটেইনেবল) রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করতে নির্বাচনপূর্ব সংস্কার প্রয়োজন।’
তিনি রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
১৯৭২ সালের সংবিধান সমালোচনা করে মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান আরও বলেন, ‘এটা মানবাধিকার সংরক্ষণে ব্যর্থ, তাই এটি পরিবর্তন করতে হবে। এ দেশের গণতন্ত্র, সাংবিধানিক অধিকারসহ সকল ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’
তিনি বিভাজিত না হয়ে, দেশের কল্যাণে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান এবং তেপান্তর সংগঠনকে এই ধরনের আয়োজন অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন।
একইসঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোকেও এ ধরনের সেমিনার ও পাঠচক্র আয়োজনের আহ্বান জানান মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান।
মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আজকের দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাবিধুর। এই দিনে রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে।’
তিনি জুলাই বিপ্লবকে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘একটি সার্বভৌম দেশে আমাদের সব ধরনের অধিকার নিয়ে বসবাস করার কথা ছিল। কিন্তু বিগত সাড়ে ১৫ বছর সরকার সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায়, নিপীড়ন ও জুলুম চালিয়েছে। বিগত সরকারের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দেশের ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তারা সে অধিকার আদায়ের অনুকূল পরিবেশ অর্জন করে।’
এ পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য জোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
মো. কামাল উদ্দিন গবেষণালব্ধ ও তথ্যধর্মী ভাষায় বলেন, ‘বিপ্লব হলো অধিকার। যেখানে বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী সরকার জনগণের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজকের প্রবন্ধকার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি প্রবন্ধকারকে আরও তথ্য (ডেটা) সংগ্রহ করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান এবং ভবিষ্যতে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের অনুরোধ জানান। উপ-উপাচার্য আরও বলেন, ফ্যাসিবাদী আমলে মানুষ তার নিজের অধিকার ও ভোটাধিকার পর্যন্ত হারিয়েছিল।’
তিনি মন্তব্য করেন, জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে এ দেশে মানবাধিকার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
মো. কামাল উদ্দিন বিগত সাড়ে ১৫ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার দাবি করেন।
মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, ‘এই জুলাই আন্দোলন বা অভ্যুথান সফল করতে পুলিশের ভূমিকা অনেক। তাদের তীব্র অত্যাচারে মানুষ মারাতে সকল শ্রেণি-পেশার নারী পুরুষ আন্দোলনে যোগদান করে এবং সরকারের পতন ঘটায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশকে বিগত ১৫ বছরে পেটুয়া বাহিনীতে পরিণত করে। তাই আগে পুলিশ বাহিনী সংস্কার করতে হবে, না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব হবে না। যে পুলিশ সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
সেমিনারের বিশেষ আলোচক, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রোকন উদ্দীন পঠিত প্রবন্ধটির যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা করেন। তিনি বিভিন্ন দেশের পুলিশ এবং বাংলাদেশের পুলিশের সাথে তুলনা করেন। তিনি পুলিশসহ পুলিশদের যারা বাধ্য করেছে গুলি চালাতে, তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনার পরামর্শ দেন। তিনি প্রবন্ধটিকে দুই ভাগে ভাগ করেন- একাডেমিক থিসিস ও পাঠচক্রের পেপার। এটি বলে তিনি এটাকে পাঠচক্র পেপার বলেন। তবে গবেষণাধর্মী হলে ভালো হত বলে মনে করেন। কিছু লোমহর্ষক ইন্টারভিউ যুক্ত করার পরামর্শ দেন। সংবাদপত্রের কিছু প্রতিবেদন যুক্ত করার পরামর্শ দেন। তিনি প্রবন্ধকে বর্ণনামূলক বলে মনে করেন। তবে এটি যুক্তিভিত্তিক হলে ভালো হত বলে মতামত ব্যক্ত করেন। প্রবন্ধটির রেফারেন্সের সীমাবদ্ধতার দিকটি তুলে ধরেন। তবে ভাষা ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তিনি আরও যুক্তি দেন যে, সাসটেইনঅ্যাবল গভর্নমেন্ট করতে হলে শুধু পুলিশ নয়, যে সকল ফ্যাসিস্ট বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে আছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলেন।
সাঈদ আহসান খালিদ বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-রাষ্ট্র যদি জনগণের পাশে না দাঁড়ায়, জনগণই একদিন রাষ্ট্রকে বদলে দিতে বাধ্য হয়। তবে সেই পরিবর্তন যদি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও দমননীতির ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখে, তাহলে গণতন্ত্র কেবল নামমাত্রই থাকবে, প্রকৃত অর্থে নয়। তিনি আরও বলেন, কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং দমনমূলক প্রশাসনিক কাঠামো এবং কর্তৃত্বমূলক আইনি কাঠামোর গঠনমূলক সংস্কারই পারে জনগণের অধিকার রক্ষায় টেকসই পরিবর্তন আনতে।’
প্রবন্ধকার সেমিনারের শিরোনামের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, এখানে পুলিশের পরিবর্তে সকল বাহিনীর নাম আসতে পারত। কারণ জুলাইয়ে প্রায় সকল বাহিনী সরকারের পক্ষে কাজ করেছে। তার প্রবন্ধে জুলাই আন্দোলনকে স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স বলে উল্লেখ করেন। বিভিন্ন মানবাধিকার আইন ও জুলাই আন্দোলনে রাষ্ট্র কর্তৃক সেই আইন লঙ্ঘন করার কথা বলেন। পুলিশের এমন আচরণের পিছনে মূলত ব্রিটিশ আমলের আইনকে দায়ী করেন এবং তা পরিবর্তন করতে বলেন। কারণ পুলিশ জনগণের বন্ধু বলা হলেও ব্রিটিশ আইন চলমান থাকলে তা কার্যকর হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ হবে জনগণের সেবক, শাসকের শোষণের হাতিয়ার নয়।’
সেমিনারে চবির স্পোর্টস সাইন্স বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. এনএম সাজ্জাদুল হকসহ বিশ্ববিদ্যালয়েরর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মী ও সুধীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।