পায়েল বিশ্বাস: বাংলা শিল্পাঙ্গনে অনেকেই আছেন, যাঁরা সরল সাদাসিধে অভিনয়ের মাধ্যমে নয়, বরং গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মায়াময় আবেগের সূক্ষ্ম ছোঁয়ায় দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে থাকেন। এই পরিসরে এক অলীক, কিন্তু অতুলনীয় মাধুর্যের অধিকারী – রফিউল কাদের রুবেল। চট্টগ্রামের প্রাণভূমিতে জন্ম, বেড়ে ওঠা এই শিল্পী, মঞ্চ ও পর্দার মাঝে এক ধ্রুপদী সেতুবন্ধনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন।
শৈশব থেকে মঞ্চের মায়াজালে:
চট্টগ্রামের পাহাড়-নদীর ছায়ায় শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে তার। স্কুলজীবন থেকেই মঞ্চের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই নাটকের পটে পিঠে দিয়ে গড়ে উঠেছে একটি অনবদ্য শিল্পমনের প্রজ্বলন। কলেজজীবনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে গড়ে তোলা ‘লোজেইওন’ থিয়েটার দল তাঁর প্রথম মঞ্চের শিক্ষক। পরে যোগ দেন প্রাচীনতম নাট্যগোষ্ঠী ‘তির্যক’- যেখানে অভিজ্ঞ ও গুণী শিল্পীদের ছায়ায় তিনি রপ্ত করেন অভিনয়ের গভীর পাঠ। এই পর্যায়ে তাঁর মঞ্চীয় উপস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মূর্তিমান; সে-সময় তাঁর চরিত্রগুলো ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সংবেদনশীল। ‘সমাধান’, ‘রক্তকরবী’, ‘তীর্থযাত্রা’, ‘লজ্জা’, ‘সত্তান্ধ’-এগুলো শুধুই নাটকের নাম নয়, রুবেলের মঞ্চজীবনের প্রতিটি আবেগের অনুরণন।
নাট্যকার হিসেবে সৃষ্টি ও ভাবাবেগের নিবেদন:
শুধু অভিনয় নয়, নাট্যকার হিসেবেও তিনি রচনা করেছেন অসাধারণ নাটক- ‘সত্তান্ধ’, ‘কাণ্ডবিতং’, ‘ভাষাবদল’, ‘লফা’, ‘মানুষ হইছে মানুষ’। এই রচনাগুলোতে তাঁর ভাবনার গভীরতা, মানব মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মতা প্রতিফলিত হয়। নাটক তাঁর কাছে শুধু বিনোদন নয়, বরং আত্মার প্রকট রূপান্তর।
ছোট পর্দায় দৃঢ় অগ্রসর
২০২১ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ধারাবাহিক ‘খড়কুটোর আখ্যান’ দিয়ে পর্দায় অভিষেক। এরপর ‘কর্পোরেট’, ‘বাঘবন্দী’, ‘হাওয়াই মিঠাই’, ‘জাল’ ধারাবাহিকগুলোতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি নাট্যদর্শকের হৃদয়ে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন।
অভিনয়ে তাঁর ছাপ মধুর, তবে কখনো তীক্ষ্ণ, প্রাঞ্জল ভাষায় সাবলীল। ‘ দ্যা ডে অফ ম্যারিজ অ্যানিভার্সাডরি’, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিস্টমেন্ট’, ‘চাটগাঁইয়া গোলমাল’, ‘শুটিং লাইভ’ নাটকে তাঁর উপস্থিতি অতুলনীয়।
পর্দায় আত্মপ্রকাশ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেড ইন চিটাগং’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে রুবেল প্রশংসার বন্যায় ভেসেছেন। এরপর ‘একটি খুনের বিবরণ’ (২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত), ‘রফিক আশিকী’, ‘উখিনু’, ‘ইনান্না’, ‘অনুধাবন’, ‘ল্যান্ড অফ বিষ্ট’, ‘অলাতচক্র’–এর মত চলচ্চিত্র ও শর্টফিল্মে অভিনয় করে তিনি দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তার অভিনয় গভীর, দৃষ্টিনন্দন এবং চিত্রনাট্যের সার্থক ব্যাখ্যা।
ওয়েব সিরিজ ও আধুনিক মাধ্যমের প্রভাব:
বর্তমান সময়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো বাংলা নাটক-চলচ্চিত্রের নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। সেখানে রুবেল ‘চরকি’ প্ল্যাটফর্মের ‘গুটি’ ওয়েব সিরিজে মাদক ব্যবসায় কেন্দ্রীয় ‘ম্যানেজার’ চরিত্রে অভিনয় করে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। শঙ্খ দাসগুপ্ত পরিচালিত সিরিজে তার পারফরম্যান্স দেখিয়ে দিয়েছেন পার্শ্বচরিত্রও কিভাবে মূখ্য চরিত্রের তুলনায় বেশি গভীর ও প্রভাববিস্তারকারী হতে পারে। নাট্যশৈলীর নিখুঁততায় তিনি নির্মাতা ও দর্শক উভয়ের প্রশংসা অর্জন করেছেন।
পারিবারিক প্রেক্ষাপটে সংগ্রামের গল্প:
অভিনয় জীবনের অগ্রযাত্রার মাঝে এক কঠিন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন রুবেল- তার কন্যা তূরী মস্তিষ্কজনিত জটিল রোগে আক্রান্ত হন। নিঃসন্দেহে এই সংকট তার ব্যক্তিজীবনে ছায়া ফেলেছিল, যার প্রভাবে এক সময় অভিনয় থেকে বিরতি নিতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু আজ তিনি সুখবর দিয়েছেন, তূরী সুস্থ; আর সেই সুখবরের আলোয় ফিরে এসেছেন নতুন উদ্যমে কাজের জগতে। এই অনুকম্পা ও দৃঢ়তায় বাঙালি দর্শক তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে।
রফিউল কাদের রুবেল আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, অভিনয় মানে কেবল মুখস্থ সংলাপ নয়, বরং আত্মার বহিঃপ্রকাশ। তার অভিনয় নির্জন, কিন্তু ভীষণ গভীর; ধীরে ধীরে দর্শকের হৃদয়ে অনির্বচনীয় চিহ্ন রেখে যায়। তিনি পার্শ্বচরিত্রের শক্তিমত্তা ও মহিমা প্রমাণ করেছেন, যেখানে মূখ্য চরিত্রের পাশেই শিল্পের আসল মর্ম নিহিত। তাঁর এই শিল্পযাত্রা যেন বাংলার নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের জন্য এক অবিচ্ছেদ্য সম্পদ হয়ে থাকে, যেখান থেকে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা অনুপ্রাণিত হয়।আসুন আমরা সবাই রফিউল কাদের রুবেলের সুস্থতা ও নবজীবনের জন্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর অভিনয়শৈলীর আরও উজ্জ্বল পথে যাত্রার সাক্ষী থাকি।