আধুনিক বাংলার অভিনয়ভুবনে যখন ‘প্রতিভা’ শব্দটি দ্রুততার সাথে নিঃশেষ হতে বসেছে, তখন এক নিঃশব্দ পথিক ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছেন- গভীর, সংযত এবং একান্ত নিজের অভিনয়ভাষায়। তিনি আয়মন শিমলা।
চট্টগ্রামের মঞ্চনাট্যের আলো-আঁধারির মধ্যে জন্ম নিয়েছে তাঁর শিল্পসত্তা। মঞ্চ ছিল তাঁর প্রথম পাঠশালা- যেখানে মুখস্থ সংলাপ নয়, চরিত্রের অন্তর্জগৎ অনুধাবন করতে শেখেন তিনি। এই শিক্ষাই পরবর্তী তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছে পর্দার অভিনয়ে, ওয়েব কনটেন্ট থেকে শুরু করে মূলধারার চলচ্চিত্রে।
শিমলার অভিনয়ের ধরনকে বিশ্লেষণ করতে গেলে এককথায় বলা যায়- তিনি উচ্চারণে নয়, দৃষ্টিতে কথা বলেন। তাঁর চোখ যেন চরিত্রের ভিতরকার বিক্ষোভ, বিষণ্নতা বা প্রগাঢ় অনুভূতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অনুবাদক। তিনি সেই অভিনেত্রী, যিনি সংলাপের প্রতি নির্ভর করেন না, বরং সংলাপের ফাঁকে থাকা নীরবতাকে ভাষায় রূপান্তরিত করতে পারেন। এই বিরল ক্ষমতা তাঁকে পার্থক্য করে দেয় অনেকে থেকে।
‘গুটি’, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’, ‘সুড়ঙ্গ’- এই ওয়েব কাজগুলিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তা দর্শকের মনে রেখাপাত করেছে গভীরভাবে। বিশেষ করে ‘গুটি’-তে তাঁর চরিত্রে চাটগাঁইয়া উপভাষার স্বাভাবিকতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় প্রমাণ করে দেয়, তিনি ভাষাকে কেবল বাহন নয়, চরিত্রের শরীর হিসেবে ধারণ করেন।
এই ওয়েব মাধ্যমে কাজের ধারাবাহিকতা তাঁকে নিয়ে যায় বড় পর্দায় এবং সেখানে তিনি হাজির হন “ওমর” সিনেমায়। এখানে তিনি ফুলি চরিত্রে অভিনয় করেন- এক গরিব, গ্রামীণ, বঞ্চিত অথচ দৃঢ়চেতা নারী। চরিত্রটি হয়তো চটকদার নয়, কিন্তু তা এক বাস্তব নারীর প্রতিকৃতি। এখানে শিমলা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যান চরিত্রে। তাঁর চোখের ভাষা, গলার স্বর, শরীরী ভাষা- সবকিছু এক কষ্টময় জীবনের সাক্ষ্য দেয়। ‘ওমর’-এ তাঁর অভিনয় যেন এই বার্তাই দেয়- নায়িকা না হয়েও একজন অভিনেত্রী কীভাবে দৃশ্যপট দখল করে নিতে পারেন। এরপর আসে তাঁর অন্যতম আলোচিত কাজ, “জংলী” সিনেমা- যেখানে তিনি লিসা চরিত্রে অভিনয় করেন। এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংকট, আত্মমর্যাদা ও একাকীত্বের যন্ত্রণাকে তিনি এখানে ফুটিয়ে তোলেন নিঃশব্দ অথচ তীব্র এক মাধুর্যে। ছবির শেষ দৃশ্যে, যেখানে লিসা বলে, “তুমি থাকো আর না থাকো, এই বাচ্চার দায়িত্ব আমি নেব। আমিই ওর মা, আমিই ওর বাবা।” এই সংলাপ কেবল সংলাপ নয়- এ যেন এক নারী হৃদয়ের প্রতিজ্ঞা, এক অদৃশ্য সংগ্রামের ঘোষণা।
শিমলার নিজস্ব ভাষাভঙ্গি, সংযম এবং সেই চাপা আবেগ- সব মিলিয়ে লিসা চরিত্রটি হয়ে ওঠে তাঁর ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। চাটগাঁইয়া উপভাষা ছেড়ে এখানে তিনি যে নতুন ভাষার স্বাদ দিয়েছেন, সেটিও তাঁর অভিনয়ের সাহসিকতা ও বহুমাত্রিকতার প্রমাণ।
আয়মন শিমলার অভিনয়ে একধরনের নীরব প্রতিবাদ আছে- বাণিজ্যিক সফলতার পেছনে দৌড় না দিয়ে, তিনি বরং ধীরে চলেন, চরিত্রকে আত্মস্থ করেন, তারপর আত্মার গভীর থেকে চরিত্রকে জাগিয়ে তোলেন। তার অভিনয়ের মধ্যে মৌলিক এক আত্মমর্যাদা রয়েছে- যেখানে একজন নারী কেবল ভালোবাসা বা করুণা পেতে আসেন না, তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন বার্তা।
তিনি মূলধারার গ্ল্যামার-জড়িত রাস্তায় হাঁটেননি, বরং বেছে নিয়েছেন প্রতিটি চরিত্রকে গভীরভাবে বোঝার এবং তাকে আন্তরিকভাবে উপস্থাপন করার কঠিন পথ। এই সাহস, এই দৃঢ়তা তাঁকে একজন শিল্পী হিসেবে সত্যিকার অর্থে উচ্চস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
আজ যখন ওটিটি এবং ওয়েব সিরিজের প্রসারে অভিনেত্রীদের জন্য নতুন নতুন ভূমিকা তৈরি হচ্ছে, সেখানে আয়মন শিমলা হচ্ছেন সেই কণ্ঠস্বর—যিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন, পার্শ্বচরিত্রও যদি যথার্থ হয়, সেটি হয়ে উঠতে পারে নায়িকার চেয়েও বেশি অর্থবহ। তাঁর সামনে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনার মাঠ। যদি নির্মাতারা তাঁর এই অভিনয়ক্ষমতাকে যথাযথভাবে কাজে লাগান, তবে খুব শিগগিরই তাঁকে আমরা দেখতে পাবো আরও জটিল, শক্তিশালী ও বহুমাত্রিক চরিত্রে।
আয়মন শিমলা আমাদের আজকের সময়ের অভিনয়ের জগতে এক আলাদা সুর- না অতিরঞ্জিত, না আড়ম্বরপূর্ণ, বরং নিবিড়, প্রজ্ঞাময় এবং আন্তরিক। তার অভিনয় দেখে মনে হয়, তিনি সংলাপ বলেন না, তিনি মানুষের না-বলা অনুভূতিকে দৃশ্যমান করেন। এই শিল্পীর যাত্রা এখনও চলমান। তিনি এখনও তৈরি হচ্ছেন, গড়ে তুলছেন নিজেকে। তবে তাঁর প্রতিটি চরিত্রে, প্রতিটি নীরবতায়, প্রতিটি দৃষ্টিতে- একটি কথা প্রতিধ্বনিত হয় বারবার- ‘আমি এসেছি, আমার ভাষা অভিনয় নয়, আমার ভাষা- আত্মার প্রকাশ।’