পায়েল বিশ্বাস: চট্টগ্রামের শিল্পাঙ্গনে এক প্রখর দীপ্তি, এক অভিজ্ঞান, এক শিল্পনাম মান্না জাকির নাজাকাত। তাঁকে কেবল ‘শিল্পী’ বলা অপ্রতুল; তিনি একাধারে নৃত্যশিল্পী, নাট্যকর্মী, সংগীতশিল্পী, রূপসজ্জাশিল্পী, নির্দেশক, চিত্রনাট্যকার, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং সমাজচেতনায় অনুপ্রাণিত একজন শিল্পসমাজ নির্মাতা। এই বহুমাত্রিক প্রতিভার পেছনে রয়েছে তাঁর পারিবারিক বৈচিত্র্য, শৈশবের সাংস্কৃতিক ছোঁয়া, এবং একনিষ্ঠ সাধনার দীর্ঘ ইতিহাস।
মান্না জাকির নাজাকাতের জন্ম ও বেড়ে ওঠা যেন নিজেই একটি নৃত্যনাট্য। তার মা সৈয়দা নিগার সুলতানা ভারতের উত্তরপ্রদেশের লখনৌ শহরের এক সম্ভ্রান্ত শিয়া সুফি পরিবারের কন্যা, যেখানে পারিবারিকভাবে গানের সুর, মার্সিয়া, শায়রি এবং দার্শনিক ভাবনা রক্তে প্রবাহিত। অন্যদিকে তার পিতা মোহাম্মদ আবদুল মতিন, নোয়াখালীর রামপুর গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সুফি পরিবারের সন্তান- যার শিকড় গ্রামীণতা, অথচ শাখায় পল্লীগীতি ও অন্তর্লীন ভাবধারা। এই দুটি সংস্কৃতির অন্তর্লীন সংযোগেই জন্ম নেয় এক সংবেদনশীল, বহুস্তরবিশিষ্ট শিল্পীসত্তা। ঘরের ভেতরে মার্সিয়ার ধ্বনি, আর বাইরের পৃথিবীতে বাউল ও লোকগানের ছোঁয়া; এই ছিল তার শৈশবের ঘরানা।
শৈশবে স্কাউট ক্যাম্পে অন্যদের নাচ-গান দেখে যে শিশুটির চোখে আগুন জ্বলে উঠেছিল, সেই আগুন আর কখনো নিভেনি। প্রথমে গান শেখা শুরু করেন কাওয়ালি ও রাগভিত্তিক ধারায়। প্রয়াত শিল্পী মুমতাজ কাওয়াল ছিলেন তার প্রথম গুরু। এরপর নিজেকে নিয়ে যান আরও উচ্চতর সংগীত-চর্চায়, গুরু সনজীব কুমার নাথ-এর তত্ত্বাবধানে। নাচের প্রতি ভালোবাসা এতটাই গভীর হয়ে ওঠে যে, মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রথম তালিম নেন ওড়িশি গুরু প্রমা অবন্তীর কাছে, এরপর ভরতনাট্যমে প্রবেশ করে গুরু শুভ্রা সেনগুপ্তর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার নৃত্যচর্চা চলে টানা ৫-৬ বছর, পরিপূর্ণ করে তুলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চার বছর মেয়াদী নৃত্যকলার কোর্সে অংশ নিয়ে।
ভাগ্য যেন নিজেই তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় আরও উচ্চতর যাত্রায়। ২০১২ সালে ভারতের কালারিপাইট্টু গুরু কাজল হাজরার দৃষ্টিগোচর হন এবং আমন্ত্রণ পান কলকাতায়। সেখানে দুই বছর গুরু-শিষ্য পরম্পরায়, খেয়ে থেকে, শিখে, নিজেকে আত্মস্থ করেন- শুধু কৌশল নয়, শিল্পের আত্মা। ফেরার পর চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজস্ব নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র “নৃত্যভূমি”। এই প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিল্পী তৈরি হয়েছে- যা মান্না জাকির নাজাকাতের শিক্ষাদানের গভীরতা প্রমাণ করে।
মঞ্চনাটকের সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘ ১৭ বছরের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা কামাল যাত্রার তত্ত্বাবধানে তিনি যুক্ত হন নাট্যাধার গ্রুপের সাথে। এই সময়ে তিনি ‘ভগা কাইন’, ‘স্মৃতি ’৭১’, ‘শিখন্ডী কথা’, ‘বধ্যভূমি’, ‘পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়’ সহ একাধিক প্রগতিশীল নাটকে অভিনয় করেন। তবে এখানেই থেমে থাকেননি। নিজেই লিখেছেন এবং নির্দেশনা দিয়েছেন একাধিক নৃত্যনাট্যে। উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল বারামখানা, ছায়াময়ী মায়াময়ী, ভাঙা মালসায় আধখানা চাঁদ, টানা হেঁচড়া, ফুলকুমারি। তার লেখা গল্প “ফুলকুমারি” নিয়ে থিমভিত্তিক ভিডিও চিত্র নির্মাণ, অভিনয় এবং নির্দেশনা সবই নিজে করেছেন- এটাই প্রমাণ করে তিনি শুধু শিল্পী নন, পূর্ণাঙ্গ এক সৃজনশীল সত্তা।
মান্না জাকির নাজাকাত তাঁর কাজের মধ্যে নারীর সৌন্দর্য, লাজ, সাহস ও প্রতিবাদ- সবই তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেকে কখনো রূপান্তরকামী নারীর রূপে গড়ে তুলেছেন কেবল সমাজকে একটি বার্তা দিতে- শিল্পচর্চা সকলের অধিকার। তার এই শৈল্পিক প্রতিবাদ নিঃশব্দ হলেও বোল্ড ও যুগান্তকারী।
ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রম। নিজের পরিচালিত ফ্যাশন হাউজে লখনৌ ঘরানার পোশাকের নকশা, থিম ও নির্দেশনা তিনি নিজেই দিয়ে থাকেন। এমনকি তিনি কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে- সাকিব আল হাসানের পেজ-ই মোনাক মাঠের প্রজেক্টেও।
তিনি নিয়মিত পরিবেশন করে থাকেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের “চেতনায় নজরুল” প্রোগ্রামে। এছাড়া চট্টগ্রামের থিয়েটার গ্রুপগুলোতে নৃত্য, যোগব্যায়াম এবং কনটেম্পোরারি নৃত্য বিষয়ে কর্মশালা পরিচালনা করে আসছেন।
তার বহুমাত্রিক শিল্প-অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা- গ্রুপ থিয়েটার উৎসব সম্মাননা (২০১৮, ২০১৯), ফ্যাশন ফর লাইফ (সিজন ৫) – বিবি রাসেলের হাত থেকে, গুণী সম্মাননা- ফ্যাশন টুগেদার (২০১৬), গ্রীন লাইফ ষষ্ঠ সংখ্যা মোড়ক উন্মোচন- ২০২৩, বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার (নৃত্য ও অভিনয়ে)।
মান্না জাকির নাজাকাত শিল্পের যে রূপটি তুলে ধরেন, তা কেবল সৌন্দর্য নয়- তা প্রতিবাদ, তা চেতনা, তা সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা।
তাঁর যাত্রা দেখায়, প্রতিকূলতার মধ্যেও শিল্পচর্চা হতে পারে মুক্তির পথ, নিজের পরিচয় গড়ার হাতিয়ার। চট্টগ্রামের মাটি তাকে ধারণ করেছে যেমন মাতৃত্বে, তেমনি বাংলাদেশ তাকে চিহ্নিত করতে পারে একটি “মডেল ইনক্লুসিভ আর্টিস্ট” হিসেবে- যিনি রূপান্তরের ভিতরে থেকেও নেতৃত্ব দিতে জানেন।