ইউসুফ ইকবাল: চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে পিন্টু দা নামে পরিচিত নাট্যতাপস অলক ঘোষ একজন আইকনিক অভিনেতা। সপ্ততিবর্ষীয় এ অভিনেতা এখনো সক্রিয় মঞ্চের মানচিত্রে। অভিনয়ে তিনি সাধক-সন্ত, সিদ্ধপুরুষ। তাঁর চেতনায়- সর্বক্ষণের ধ্যান, জ্ঞান, স্বপন, জাগরণ ও মননের কেন্দ্রে থাকে অভিনয়-চিন্তন। শৈশব থেকে তাঁর অভিনয়ের সাথে বসবাস। একজীবনের প্রায় পুরোটাই তিনি হেসে খেলে কাটিয়ে দিলেন মঞ্চে ও মহড়ায়।
অলক ঘোষের পরিবারকে বলা যায়- আভিনয়িক পরিবার। তিন প্রজন্মব্যাপী তাঁর পরিবার অভিনয়ে নিবেদিত। তাঁর অভিনয় প্রতিভা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। মা ছিলেন মঞ্চের অভিনয়-সাধিকা। মাতৃগুণ পরিবেষ্টিত পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা পুত্র মাতৃস্মৃতিতে খুঁজে পেয়েছেন অভিনয়ের অনুপ্রেরণা। দুই ভাই অভিনেতা। সহধর্মিনীও অভিনয় করেছেন অজস্র নাট্যসন্ধ্যায়। তাঁর অধস্তন প্রজন্মও- বিশেষত কন্যা- অভিনয়ে একাধিকবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত। এমন সমৃদ্ধ অভিনয়শিল্পী পরিবারের সদস্য হয়েও তিনি যাপন করেন নিরহংকার সাধারণ শিল্পীজীবন। তিনি অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠ, সদালাপী, আড়ালপ্রিয়, অনাড়ম্বর। তাঁকে বলা যায়- নির্ঝঞ্ঝাট, কলহমুক্ত, সজ্জন ও সহজ মানুষ। ফলত, তিনি নিয়ত সহজ সরল পথের পথিক। তাঁর ভেতরের সাথে বাহিরে কোন বৈপরীত্য নেই। চিন্তন, কথন ও কর্মে রয়েছে তাঁর অভিন্ন রূপ। বিনয় তাঁর ভূষণ। উপচে পড়া আন্তরিকতায় পূর্ণ তাঁর অন্তর। পরিচয়ের সামান্য সূত্র ধরে তিনি মানুষকে জড়িয়ে ধরতে পারেন হৃদয়ের পরম উষ্ণতায়- হার্দ্য আলিঙ্গনে।
বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে অলক ঘোষের সম-বয়সীরা এখন আর কেউ মঞ্চে ওঠেন না। নাটকের মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানো তিনিই এখন সবচেয়ে বয়সী অভিনয়যোদ্ধা। এখনও তিনি মেকাপ, গেটাপ, পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে পাদপ্রদীপের আলোতে দাঁড়িয়ে রূপান্তরিত হয়ে যান ভিন্ন ব্যক্তিত্বে। নাট্যকারের কল্পিত কল্পনাকে নিজের মননে জারিত করে তিনি গভীর মমতায় রূপদান করেন আখ্যানের অদৃশ্য চরিত্রকে। নিজেকে ভেঙেচুরে নানা চরিত্রে আত্মপ্রকাশেই তাঁর আনন্দ। কমার্শিয়ালের মেলো-নাট্যের বিনোদনে তিনি যেমন সফল তেমনি নবনাট্যের নিরীক্ষাধর্মী শিল্পসৃষ্টিতেও তিনি সার্থক। অভিনয়ে তিনি সহজাত শিল্পপ্রতিভা। এক্ষেত্রে তিনি ভীষণ ক্ষুধার্ত- তাই সর্বভূক। বাণিজ্যিক, শৈল্পিক, পেশাদার; মঞ্চ, ময়দান, বেতার, টেলিভিশন, সিনেমা; প্রথাগত, প্রথাবিরুদ্ধ, নিরীক্ষামূলক- সর্বক্ষেত্রের অভিনয়ে রয়েছে তাঁর স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল বিচরণ। তিনি আপাদমস্তক অভিনেতা। অভিনয় তাঁর কাছে অনেকটা জীবন সাধনার নামান্তর।
অভিনয়ের পাশাপাশি অলক ঘোষ একজন নাটককার, দক্ষ সংগঠক, নিবেদিত নির্দেশক। সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি চারিত্রিক সারল্যমণ্ডিত একজন উদার ও উত্তম ব্যক্তি- চট্টগ্রাম নাট্যাঙ্গনের সর্বজন গ্রহণযোগ্য মান্যজন। অর্থ নয়, বিত্ত নয়, প্রতিপত্তি নয়- কেবল শৈল্পিক, সামাজিক ও মানবিকগুণের কারণেই তিনি লাভ করেছেন শ্রদ্ধার অমূল্য আসন। অভিনেতা হিসাবে সমধিক পরিচিত অলক ঘোষ চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনেরও একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এ আন্দোলনের উন্মেষ ও বিকাশপর্বের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মনিবেদন ও অবদান। নাট্যচর্চার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নানা প্রতিকূলতা, ভাঙচুর, উত্থান-পতনসহ বিকাশের নানা প্রান্তের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি। সমূহ কারণে কালের বর্তমান প্রান্তে এসে অলক ঘোষ হয়ে উঠেছেন নাট্যচর্চা গবেষণায় অপরিহার্য ও অনিবার্য তথ্যসূত্র। অথচ, কী আশ্চর্য তিনি নিজেই অনালোচিত থেকে গেলেন নাট্যপ্রাঙ্গণে।
চট্টগ্রামের মঞ্চের মানচিত্রে অলক ঘোষ একজন অনন্য অভিনয়শিল্পী। ল্যান্ডমার্কের মতই তিনি দৃপ্ত ও দৃশ্যমান। আমরা দ্বিধাহীনভাবে, আনন্দ ও গর্বের সাথে তাঁর নাম উচ্চারণ করি এবং চিৎকার করে বলি- শোনো হে নিখিল নাট্যাঙ্গন, চট্টগ্রামের একজন অভিনেতা- অলক ঘোষ তাঁর নাম- সপ্ততি বছর বয়সেও তিনি অভিনয় দিয়ে মঞ্চ মাতান। জাতীয় স্বীকৃতির স্পটলাইটটা এবার তাঁর উপর ফেলুন।
লেখক: শিক্ষাজীবী, চট্টগ্রাম।