চট্টগ্রাম: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘যারা জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনে ছিল না, এখন তারাই বলছেন, নির্বাচন না হলেই ভালো। তারা এক ধরনের সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু জনগণ তাদের এ সুযোগ বেশি দিন দেবে না। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন ছাড়া কাউকে ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা দেবে না। যারা নির্বাচন ঠেকাতে চায়, তাদের প্রতি দেশের মানুষের বার্তা স্পষ্ট। তাদের জনগণ ক্ষমা করবে না এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মাটিতে তাদের কোনো ইচ্ছাও পূরণ হবে না। জনগণ নির্বাচন ঠেকাতে চাওয়া শক্তিকে ক্ষমা করবে না।’
বৃহস্পতিবার (১ মে) বিকেলে সিটির কাজীর দেউরীর নাসিমন ভবনস্থ বিএনপির কার্যালয়ের সামনে নুর আহম্মদ সড়কে মে দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিক দলের শ্রমিক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিক দলের সভাপতি এএম নাজিম উদ্দীনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শেখ নুরুল্লাহ বাহারের পরিচালনায় সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বাক ইদ্রিস মিয়া।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু আরো বলেন, ‘বিএনপির ৩১ দফা রোডম্যাপে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা এবং তাদের পরিবারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণমূলক পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় যেভাবে শ্রমিক স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।’
তিনি বলেন, ‘দেশে এখন নির্বাচিত সরকার নেই। ফলে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা, পারিশ্রমিক ও চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। মালিক ও প্রশাসনের একচেটিয়া অবস্থানে শ্রমিকেরা নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। তাই সবাইকে এগিয়ে এসে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিতে সহায়তা করতে হবে। ন্যায্য পাওনা আদায়ের লড়াইয়ে শ্রমিকদের পাশে আছে বিএনপি।’
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সম্ভাব্য ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের কথাবার্তা প্রসঙ্গে আমির খসরু বলেন, ‘যদি দেশে একটি নির্বাচিত সরকার থাকত, তাহলে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে সংসদে আলোচনা হতো, জনগণের মতামত বিবেচনা করা হতো। অথচ এখন এমন সিদ্ধান্ত কে নিচ্ছে, কাদের সঙ্গে বসে নিচ্ছে, তা জাতি জানে না।’
তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘জাতিসংঘের একজন প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্মতিতেই কেবল এই করিডোর সম্ভব, তাও নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনের শর্তে। তাহলে এখন যারা বাইরে বসে এসব দিচ্ছেন, তারা কীভাবে এত সাহস পাচ্ছেন?’
আমির খসরু বলেন, ‘শ্রমিকদের আন্দোলন হতে হবে শান্তিপূর্ণ এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ। যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক না ছড়ায় এবং দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের অবদান ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন ও রাজনীতি কোনোটিই সম্ভব নয়। যারা এ দেশের শিল্প কারখানা, অবকাঠামো, পরিবহন খাতকে সচল রাখেন, তাদের বাদ দিয়ে দেশের কোনো অগ্রগতি সম্ভব না।’
‘আমরা গত ১৬ বছর ধরে লড়াই করছি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। গণতন্ত্রের বাহনই হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া জনগণের ক্ষমতায়ন ও জবাবদিহিমূলক সরকার গঠন সম্ভব নয়। নির্বাচন ছাড়া জনগণের মালিকানা ফেরানো সম্ভব নয়।’
আমীর খসরু বলেন, ‘যারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, তারা নিজেরাই অনির্বাচিত সরকারের সুবিধাভোগী। তারা এখন নানা শর্ত দিচ্ছে, এই না হলে নির্বাচন হবে না, ওই না হলে নির্বাচন হবে না। এসব বলে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। কারণ, তারা জানে, সুষ্ঠু নির্বাচনে গেলে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান মুখ থুবড়ে পড়বে।’
শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘শ্রমিকরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বাচবে। প্রয়াত জিয়া একজন শ্রমিকের বেশেই খাল খনন করেছিলেন। খালেদা জিয়া শ্রমিকদের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন। শিকাগো শহরে শ্রমিকরা ৮ ঘন্টার শ্রমের দাবিতে আত্বহুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখনো শ্রমিকরা অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। আমি চট্টগ্রামের একজন সেবক হিসেবে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের ৪১ টি ওয়ার্ডের শ্রমিকের জন্য ২০ হাজার টিসিবি কার্ডের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিচ্ছি। তারা বয়স্ক ভাতা পাবেন। শ্রমিকরা মারা গেলে তাদের স্ত্রী বিধবা ভাতা পাবেন। আমি শ্রমিকদের জন্য নাগরিক কার্ডের ব্যবস্থা করবো। দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে তারা নাগরিক কার্ডের আওতায় ভাতা পাবেন। আমরা শ্রমিকদের পক্ষে আছি।’
গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ‘দেশ থেকে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটেছে, এখন নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। শ্রমিকদের মুক্তি ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ নতুন যাত্রাপথে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা অপরিহার্য। মে দিবসের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে, যাতে পরিবর্তনের সুফল শ্রমিক মেহনতি মানুষ প্রকৃত অর্থে ভোগ করতে পারে।’
আবুল হাশেম বক্কর বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজের ভাগ্যোন্নয়নে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলো। প্রয়াত জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন যথার্থ শ্রমিক। তিনি নিজেকে সব সময় একজন শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। শ্রমিকদের দুটো হাতকে তিনি উন্নয়নের চাবিকাঠি বলতেন। এদেশের শ্রমিকের কল্যাণে তিনি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।’
এরশাদ উল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী দুঃশাসনের প্রকোপে শ্রমিক শ্রেণী ছিল সবচেয়ে নির্যাতিত। গত বছর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের সাথে শ্রমিকদের আত্মদানের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসীবাদের পতন হয়। এখন শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা না। তারপরও শ্রমিকরা অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত। বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে একটি দফা আছে। দেশে গণতান্ত্রিক সরকার আসলেই শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।’
ইদ্রিছ মিয়া বলেন, ‘মে দিবস শ্রমিকদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। আজ আমরা নতুন বাংলাদেশের পথে হাঁটছি। একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তণ, ভোটাধিকার প্রয়োগ, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা শ্রমিকের আজন্ম স্বপ্ন। ১ মে বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজের দৃপ্ত শপথের দিন। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
এএম নাজিম উদ্দীন বলেন, ‘এদেশে শ্রম আইন সংস্কার ও আধুনিকীকরণ, বেতন ও মুজুরী কমিশন গঠন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজের ভাগ্যোন্নয়নে যথাযথ কর্মসূচি নিয়েছিল বিএনপি। পোশাক শিল্পে প্রয়াত জিয়ার অবদান অবিস্মরণীয়। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতাসীন হলে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ ও অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে।’
সমাবেশে বক্তব্য দেন উত্তর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ হালিম, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ আজিজ, আবদুস সাত্তার, এসএম সাইফুল আলম, কাজী বেলাল উদ্দিন, শফিকুর রহমান স্বপন, শাহ আলম, ইয়াছিন চৌধুরী লিটন, আহমেদুল আলম চৌধুরী রাসেল, মঞ্জুর আলম চৌধুরী মন্জু, কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শ ম জামাল উদ্দিন, রেলওয়ে শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এমআর মঞ্জুর, উত্তর জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি আবদুল মোতালেব চৌধুরী, বিভাগীয় শ্রমিক দলের প্রচার সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিকী, দপ্তর সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, শিক্ষা সম্পাদক ইকবাল হোসেন।