আধুনিক বাংলা গানের রাজপুত্র, প্লেব্যাক সম্রাট, কিংবদন্তী জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠ ছিল বাংলাদেশের সম্পদ। এমন সুরেলা কণ্ঠ হয়তো শত বছর অপেক্ষা করলেও আমরা পাব না। তবে তাঁর গাওয়া গানগুলো আমাদের সংগীতাঙ্গনকে যে সমৃদ্ধ করেছে—তাতেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
এন্ড্রু কিশোরের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে; সেখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই সংগীতে অনুরক্ত ছিলেন তিনি। এন্ড্রু কিশোর প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন, যার ৯৫ ভাগই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে মুখে তাঁর গাওয়া গানগুলো তাঁকে স্মরণ করবে অনন্তকাল। এমন সুরের যাদু মাখা কণ্ঠ এই উপমহাদেশে বিরল। তিনি যে গানই গেয়েছেন, সে গানই সুপার ডুপার হিট হয়েছে।
তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প; হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে; ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে; আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি; বেদের মেয়ে জোসনা আমায়; ভালো আছি ভালো থেকো; তুমি মোর জীবনের ভাবনা; সবাই তো ভালোবাসা চায়; আমার বুকের মধ্যেখানে; বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান; চাঁদের সাথে আমি দিব না; কারে বলে ভালোবাসা; আমি চক্ষু দিয়া; তোরা দেখ দেখ দেখ রে চাহিয়া; পড়েনা চোখের পলক; বাংলাদেশের বুক এতই বিশাল—ইত্যাদি।
প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনায় পড়লেও গানই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। একসময় গানের নেশায় এন্ড্রু কিশোর ছুটে আসেন রাজধানী ঢাকায়।
চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে; ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটির মধ্য দিয়ে। এরপর বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’তেও কণ্ঠ দেন তিনি। ১৯৭৯ সালে ‘প্রতিজ্ঞা’ চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গান গাওয়ার পর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাঁকে। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে একক আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। এই দীর্ঘ সময়ে এমন কোনো মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি নেই যেখানে এন্ড্রু কিশোরের গান ছিল না। বাংলা ছবি মানেই এন্ড্রু কিশোরের গান।
উপমহাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে। কিংবদন্তী এই শিল্পী জীবনে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি মোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন ৫ বার। এছাড়াও মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গান ও সাল: বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২), সারেন্ডার (১৯৮৭), ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১), কবুল (১৯৯৬), আজ গায়ে হলুদ (২০০০), সাজঘর বিজয়ী (২০০৭), কি যাদু করিলা (২০০৮)। এসব চলচ্চিত্রে তিনি শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান।
বাচসাস পুরস্কারপ্রাপ্ত গান ও সাল: স্বামী স্ত্রী (১৯৮৭), প্রেমের তাজমহল (২০০১), মনে প্রাণে আছ তুমি (২০০৮), গোলাপি এখন বিলাতে (২০১০)। এছাড়াও ১৯৯৮ সালে ‘পদ্ম পাতার পানি’ গানটির জন্য মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পান তিনি।
এন্ড্রু কিশোর চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তাঁর গান এখনও আমাদের হৃদয় জুড়ে রয়ে গেছে।
















