শীতের সবজির উত্তাপ কোনভাবেই কমছে না। দাম না কমার সবচেয়ে বড় কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। কৃষকের ক্ষেত থেকে ভোক্তার ঝুড়ি পর্যন্ত সবজি বদলায় কমপক্ষে পাঁচ-ছয় হাত। আর প্রতিটি হাতবদলে বাড়ে কেজিপ্রতি ৫-২০ টাকা। ফলে কৃষক যেমন ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত, তেমনি বাড়িতে দামে পুড়ছেন ভোক্তা। আর এই পুরো সমীকরণে লাভবান হয় শুধুই মধ্যস্বত্বভোগীরা।
প্রকৃতিতে শীতের আমেজ, কিন্তু সবজির বাজার উত্তপ্ত। মৌসুমি সবজির দামে নেই শীতের ছোঁয়া। জীবনযাত্রার ব্যয় যখন লাগাতার বাড়ছে, তখন ভোক্তার খাবারের তালিকা ছোট হওয়াই যেন নিয়তি। প্রতি বছর শীত মানেই সস্তা দামের আশ্বাস, কিন্তু বাস্তবতা- পুরোপুরি উল্টো।
বাজার কিংবা, মহল্লা, দামের তারতম্য নিয়েও বেজায় অখুশি ক্রেতারা। দামের উত্তাপে ভোক্তার জন্য রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সকালটা শুরু হচ্ছে ভরপুর হতাশা নিয়ে। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারে শীতের নতুন সবজি উঠলেও দাম পড়তির লক্ষণ নেই। ক্রেতারা কিনছেন কম, মুখে হতাশার ছাপ। তাদের অভিযোগ, শীতকালীন সবজির দাম অনেক চড়া। দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই বাজারে। সবজি কিনেই বাজারের সব টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তবে আরও এক মাস গেলে দাম কমতে পারে বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এবার বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় ফসল ঠিকভাবে হয় নি। তাই, পর্যাপ্ত সরবরাহের অভাবে দাম বেশি।
কিন্তু এই আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না কেউই। এদিকে, শহুরে বাজারের চিত্র যেমন হতাশার, তেমনি পাড়া-মহল্লার অলিগলির চিত্র আরও ভয়াবহ। ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতাদের কাছে বাজারের তুলনায় বাড়তি গুনতে হয় কেজিতে অন্তত ২০ টাকা। তাদের অভিযোগ, পাইকারি বাজারের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি তারা। ফড়িয়ারা সিন্ডিকেট করে সবজির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে দাম কমে যাবে।
বাজারের যখন এই হাল, তখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, যেখানে সবজি উৎপাদন হয়, সেখানে কী পরিস্থিতি? সিন্ডিকেটের শেকড় খুঁজতে এবার মানিকগঞ্জে সময় সংবাদ।
সরেজমিনে দেখা যায়, যান্ত্রিক শহর ঘুম থেকে জাগার আগেই গ্রামের হাটে জমে ওঠে সবজি বিক্রি। কৃষকের হাতে থাকা বেগুন, ফুলকপি, সিম-সবই রাজধানীর থেকে অন্তত তিন গুণ কম দামে মিলছে।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, ‘শহরে বেশি দামে সবজি বিক্রি হলেও কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। কমিশন নিয়ে ফড়িয়ারা নিজেদের পকেট ভরছে। প্রতি হাত বদলেই তারা সবজির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভোক্তারা বেশি দামে কিনলেও, তার লাভ কৃষকের হাতে পৌঁছায় না তেমন।’
মূলত এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে সিন্ডিকেটের কারসাজি। কৃষকের ক্ষেত থেকে সবজি যায় স্থানীয় ফড়িয়ার কাছে, তারপর আড়ত-সেখান থেকে ঢাকার আরেক মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে। এরপর পাইকার হয়ে পৌঁছায় খুচরা দোকানদারের কাছে। এভাবে ৫-৬ ধাপ পেরিয়ে আসে সবজি আসে ভোক্তার পাতে। প্রতিটি ধাপেই দাম বাড়ে ৫ থেকে ২০ টাকা। তাই গ্রামের বাজারে ৩০ টাকার সবজি ঢাকায় এসে সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হল- এই বাড়তি টাকার ভাগে কৃষকের হিস্যা কোথায়? কৃষকরা বলছেন, ‘সেই হিস্যা থেকে যায় মাটির কাছেই। ভোরের আলো ফোটার আগেই মাটির কাছে নত হয়ে জমিনে সোনা ফলান চাষিরা। তবে বাজারে মেলে না কাঙ্ক্ষিত দাম।’
বাজারের অন্যায় দামে হতাশায় নিমজ্জিত মানিকগঞ্জের কৃষক খালেকুজ্জামান। তিনি একা নন, দেশের লাখো খালেকুজ্জামানের (কৃষকের) গল্প একই। শ্রম ও ঝুঁকি তাদের, কিন্তু লাভটুকু ভোগ করছেন অন্য কেউ। তবুও মাটির দিতে উবু হয়ে ধ্যানমগ্ন থাকেন কৃষক। তারা বলছেন, ব্যাপারীরা লাভের গুড় খায়, আর কৃষক গুনে লোকসান। দেখার কেউ নেই।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট- শীতের সবজির বাজারে অস্থিরতার মূল কারণ উৎপাদন ঘাটতি নয়, বরং দীর্ঘ সরবরাহচেইনে ছড়িয়ে থাকা মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য। কৃষকের ঘামঝরা পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসল ভোক্তার ঝুড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে দামের এমন উল্লম্ফন ঘটে যে ক্ষতিগ্রস্ত হন দুই প্রান্তের মানুষই। ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষক আর অতিরিক্ত দামে পুড়তে থাকা ভোক্তার মাঝে দাঁড়িয়ে লাভের ভাগটুকু তুলে নিচ্ছে সিন্ডিকেটচক্র। এই চক্র ভাঙা এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা ছাড়া শীতের সবজির বাজারে স্বস্তি ফিরবে-এমন আস্থা কারও নেই।
















